× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নাগরিক জীবনের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩ ১০:৫৪ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

বর্তমান সময়কে বলা হচ্ছে কানেকটিভিটির যুগ। হাতের মুঠোয় ফোন আর গ্যাজেট। সারাক্ষণই বিভিন্ন নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকছি আমরা। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে করতে আমরা যে বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছি তা হলো নিঃসঙ্গতা। এই লেখাটি যখন লিখছি তার কয়েকদিন আগে বুয়েট এবং রুয়েটের দুই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত খবর পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় আজকাল ঘন ঘন ভেসে উঠছে। একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির যুগে দিন দিন নিঃসঙ্গতা আমাদের ওপর কঠিনভাবে চেপে বসেছে। গ্রাম কিংবা শহর, কোলাহলে থেকেও কিছু মানুষ নিঃসঙ্গ অনুভব করেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে - নিঃসঙ্গতা তো চোখে দেখা যায় না, এই অনুভুতিটা আসলে কেমন?

এই নিঃসঙ্গতা বনফুলের 'নিমগাছ' গল্পের মতো। বাড়ির বউ ঘরের সব কাজ করে, সবার সেবা করে, সবাই তার ভালোটুকু নিংড়ে নেয়, তার কপালে কাজের কিছু প্রশংসাও জোটে। কিন্তু অন্তরে তার অসীম শূন্যতা সেখানে শুধুই নিঃসঙ্গতার হাহাকার। এই অনুভূতি মানুষ ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন না। চার্লস ল্যাম্বের ‘সুপারঅ্যানুয়েটেড ম্যান' রচনার মধ্যেও আছে এই নিঃসঙ্গতা। এখানে লেখক অফিসে বসে ফাইলের পর ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ক্লান্তিবোধ করতে থাকেন। তার শিল্পীসত্তা ও কর্মীসত্তার মধ্যে ক্রমবিরুদ্ধতা দানা বাঁধতে থাকে। নিজের নিঃসঙ্গতার কথা কাউকে ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারেন না। অফিসের কাজে ভুল হতে থাকে। শেষে একদিন চাকরিটাই ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন। বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা তার বিখ্যাত গল্প 'মেটামরফোসিস' (রূপান্তর)-এ দেখিয়েছেন মানুষের একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও মনোজাগতিক টানাপড়েন। নভেলাটিতে গ্রেগর একটি প্রতীক, এক ধরনের রূপক, যে একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখে একটা গা ঘিনঘিন করা পোকায় রূপান্তিত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। মানুষের নিঃসঙ্গতা বা অস্তিত্বের এই সংকট সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে অস্তিত্ববাদী দর্শনে। দার্শনিক সোরেন কীর্কেগার্ড তার একটি গ্রন্থে লিখেছেন, 'আমরা আছি, কিন্তু আমাদের থাকার কোনো ভিত্তি নেই।' সমূহজীবন থেকে বিচ্ছিন্নতার এই আর্তি কার্ল জেসপার্স, মার্টিন হাইডিগার এবং জাঁ পল সার্ত্রের দর্শনে আরও পরিচিতি লাভ করেছে।

গবেষণা বলছে, সামাজিক পরিসরের নিঃসঙ্গতা আধুনিক মানুষের জন্য এক নীরব ঘাতক। কেবল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে নিঃসঙ্গ জীবন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিগহ্যাম যুব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি আধুনিক জীবনে নিঃসঙ্গতার প্রভাব নিয়ে এই গবেষণা চালিয়েছেন। তারা বলছেন, একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন স্বাস্থ্যের জন্য দিনে ১৫টা সিগারেট খাওয়া কিংবা অতিরিক্ত মুটিয়ে যাওয়ার চেয়েও ক্ষতিকর হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিষণ্ণতা রোগের বোঝা সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করবে। তাদের হিসাবে বছরে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে বেশির ভাগ আত্মহত্যাই ঘটে বিষণ্নতার কারণে। সম্প্রতি বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের বাসিন্দাদের নিয়ে করা এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। লোনলিনেস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড : এজ, জেন্ডার অ্যান্ড কালচারাল ডিফারেন্সেস ইন লোনলিনেস' শিরোনামের ওই স্টাডিতে বিভিন্ন বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থান ও লিঙ্গের মানুষের জীবনে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা কতটা প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। সমীক্ষাটি থেকে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, মধ্যবয়সিদের তুলনায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি একা। আবার বয়স্কদের তুলনায় মধ্যবয়সিদের একাকিত্বের সমস্যা বেশি। পুরুষদের চেয়ে বেশি একাকিত্বের সমস্যায় ভুগছেন নারীরা। আমরা সাধারণেরা একাকিত্ব অনুভব করতে পারি, তবে তা ব্যাখ্যা করতে পারি না। ক্রমেই আমরা সমষ্টি থেকে একা হয়ে যাচ্ছি। একাকিত্ব একদিক থেকে আমাদের জীবনীশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে কাছের মানুষ থেকে এমনকি পৃথিবী থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও সত্য, জাপানে মানুষের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব এত বেড়ে গেছে যে ২০২১ সালে একজন নিঃসঙ্গতাবিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দিতে হয়েছে। শুধু জাপানেই নয়, ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যও একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছে। অপরদিকে আমাদের দেশে এখনও এ বিষয়গুলোকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখাই হয় না। বড়জোর মানসিক ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বিষয়টায় সমাপ্তি টানি।

ইদানীং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে একটি ধারাবাহিক বেশ আলোচনায় এসেছে। কল্লোল লাহিড়ীর লেখা কাহিনী অবলম্বনে তৈরি 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল'। খুলনার কলাপোতা গ্রামের ইন্দুর বিয়ে হলো কলকাতায়। দোজবরে মাতাল এক পুরুষের সঙ্গে। তিন সন্তান নিয়ে অল্পকালেই বিধবা। এখন ইন্দুবালার বয়স সত্তর। এই বয়সেও তিনি নিজ হাতে রেঁধে বেড়ে খাওয়ান সবাইকে। মাঝে মাঝেই ইন্দুবালা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। অনেকের মধ্যে থেকেও কখনও তিনি নিঃসঙ্গবোধ করেন, কখনও একাকিত্ব, আবার কখনও বিষণ্ণতায় ভোগেন। দারুণ ব্যাপার হলো বেঁচে থাকতে গিয়ে ইন্দুবালা নিজেই তার জীবনীশক্তি তৈরি করে নিয়েছেন। ভাতের হোটেল খুলেছেন। রোদ, ঝড় ,বন্যা, অসুস্থতায় একদিনের জন্যেও তা বন্ধ রাখেননি। কিছু একটা নিয়ে মেতে থেকেছেন, নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন, অতিথি খাইয়ে জীবনে ভালো থাকার মন্ত্র খুঁজে বের করেছেন। মুশকিল হলো- সবাই এমন উৎস খুঁজে পায় না। আবার সবার সমস্যার ধরনগুলোও এক রকম নয়। সামাজিক বৈষম্য, অস্থিরতা, বঞ্চনা, দারিদ্র্য আমাদের আমাদের চারদিক থেকে চেপে ধরে আছে। এই চাপ ব্যক্তির একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। এই বিষয়গুলোকে সামাজিকভাবে স্বীকার না করার একটা প্রবণতা আমাদের মধ্যে প্রবল। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে অথবা সামাজিকভাবে এসব ধরনের মনোজাগতিক সংকট সমাধানে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় না। অনেক সময় সমস্যার সমাধান নিজেকেই বের করতে হয়- যা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

এডওয়ার্ড মাইকেল বিয়ার গ্রিলসের নাম শোনেনি এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম জায়গায় কীভাবে একা টিকে থাকতে হয় তিনি তাই দেখিয়েছেন 'ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড' অনুষ্ঠানে। কোনো এক অচেনা দ্বীপে, কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র, কখনও মহাসাগরের অথবা কখনও কোনো বরফাচ্ছন্ন এলাকায় ভয়ংকর পশু থেকে অথবা বিপদসংকুল আমাজনের মতো জঙ্গল থেকে কীভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় এমন হাজারো কৌশল দেখিয়েছেন বিয়ার গ্রিলস। এ তো গেল একা একা যুদ্ধ করে অজানা পথ থেকে লোকালয়ে ফিরে আসার গল্প। অন্যদিকে আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের সঙ্গে একাই লড়াই করে চলেছে। এখানে 'ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড'-এর মতো নেই কোনো চার্মিং মোমেন্ট, আছে শুধু হতাশা। এখান থেকে উদ্ধার করার মতো আমাদের সামনে কোনো বিয়ার গ্রিলস নেই। তা হলে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কী উপায়?

যেটা মনে হয় তা হলো- প্রথম দরকার সামাজিক সুরক্ষার। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে এর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপর ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ হলো, ‘দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি সম্ভব হলে শরীরচর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। ভোরবেলা উঠে হাঁটার সঙ্গে প্রকৃতি পাঠ শরীর ও মনের জন্য খুবই উপকারী, তাই সম্ভব হলে রোজ হাঁটতে হবে সেই সাথে বই পড়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সৃষ্টিশীল কাজে অংশ নেওয়া যেতে পারে।' একটি বাস্তবতা সব সময় মনে রাখা জরুরি এ জীবন পুষ্পশয্যা নয়। এ জীবনে উত্থান আছে পতনও আছে, আছে নাগরিক জীবনের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব এবং বিষণ্ণতা। অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্বকে শুশ্রূষা দিতে হবে। অভিভাবকদের আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে তরুণ প্রজন্মের ওপর। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ সংকট কাটিয়ে উঠব- এটাই প্রত্যাশা।


  • লেখক ও সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা