অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
পুরোনো কথা দিয়ে শুরু করি। কাকডাকা ভোর শব্দটি আমাদের পরিচিত। তবে আজকের সমস্যা, কাকডাকা ভোর শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় কমছে। এর বর্ণনা এখন শুধু বইয়ের পাতাতেই। তাও আবার দু-দশ বছর আগে যারা লিখেছেন তাদের বইয়ে। অথচ কাকের শহর হিসেবে সুনাম-দুর্নাম দুই-ই ছিল ঢাকার। শহরের যত্রতত্র ছিল কাকের উপস্থিতি। এখন অনেক এলাকাতেই কাকের দেখা মেলা ভার। পথে, ফুটপাথে, টং দোকানের সামনের খোলা জায়গাগুলোতেও ছিল কাকের জটলা। আর আজ? খোদ ঢাকা শহরেও গ্রীষ্মের এই অলস দুপুরের নীরবতা ভঙ্গ হয় না কা-কা ধ্বনিতে। কাকের উপস্থিতিকে বিরক্তিকর ভাবা হলেও প্রকৃতির ঝাড়ুদারখ্যাত এই বুদ্ধিদীপ্ত পাখিটিকে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা গল্পকথা, ব্যঙ্গ-কৌতুক। পাথর ফেলে তৃষ্ণার্ত কাকের কলসি থেকে পানি খাওয়ার গল্প আমাদের মুগ্ধ করে। ‘দিল্লিতে কত কাক আছে?’ সম্রাট আকবরের এ প্রশ্ন শুনে বীরবল বলেছিলেন, ‘জাঁহাপনা, বর্তমান আছে ৯ লাখ ৯ হাজার ৯৯৯টি কাক।’ বীরবল বিস্মিত সম্রাটকে সন্দেহ মুক্ত হতে সংখ্যাটি গুনে দেখার পাশাপাশি জানিয়েছিলেন, যদি দেখেন, কাকের সংখ্যা কম, বুঝবেন ওরা আশপাশে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেছে। আর যদি দেখেন বেশি, বুঝবেন ওদের বন্ধু বা আত্মীয়রা বেড়াতে এসেছে!
আমাদের শহরের
কাকেরাও বেড়াতে গেছে বলে সান্ত্বনা খুঁজলেও, আদতে এটাই সত্যি যে, কাকের অভয়ারণ্যতেও
কাকের সংখ্যা কমছে। নগরে দেখা পাখিদের ভেতরে কাক এবং চড়ুইয়েরই সংখ্যাধিক্য, শহরে এদেরই
প্রাধান্য। অথচ এখন দিনের অন্যান্য সময়ে তো বটেই, ভোরের রাস্তাতেও যত্রতত্র কাকের দেখা
মেলে না। সে কি আমারই চোখের ভুল? নাকি, সত্যিই ঢাকায় নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া আর কাকের
দেখা মিলছে না? ভোরে কাকের কর্কশ স্বর শুনি না। কাকের সংখ্যা কমলে যে বিপদ ঋতুরাজ বসন্তের
আগমন বার্তা নিয়ে আসা কোকিলেরও। কাক না থাকলে সেই-বা বংশবৃদ্ধি করবে কী করে?
১৩ মে প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির বয়নশিল্পী।’
এক সময় আমাদের গ্রামাঞ্চলে ছিল সারি সারি উঁচু তালগাছ। সেসব গাছে ঝুলত বাবুই পাখির
দৃষ্টিনন্দন বাসা। আমরা তালগাছ কেটে ফেলছি। ফলে তালগাছের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই
পাখি ও বাবুয়ের বাসা। বাবুই তাল শাখাতেই তালপাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে বাসা
বাঁধে। তালের সঙ্গে যে শুধু বাবুই পাখিরই সম্পর্ক তা তো নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বজ্রপাতের
সম্পর্কও। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে বজ্রপাতে ১ হাজার
৮৭৮ জন মারা গেছেনÑ যাদের ৭২ শতাংশই কৃষক। এর কারণ, তারা খোলা মাঠে কাজ করেন, যেখানে
এক সময় উঁচু গাছ ছিল, তালগাছ ছিল। এখন উঁচু গাছও নেই, তালগাছও নেই। ফলে বজ্রপাতে মৃত্যুর
ঝুঁকি ও সংখ্যা বেড়েছে। ইদানীং তালগাছ লাগানোর কথা বলা হয়, অথচ যেগুলো রয়েছে, সেগুলো
না কাটার কথা বলা হয় না। কথায় আছে, যে তালগাছ লাগায় সে তাল খেতে পারে না। কারণ, তালগাছ
বড় হতে সময় লাগে প্রায় ২০-৩০ বছর।
‘কুঁড়েঘরে থেকে
শিল্পের বড়াই করা’ বাবুর পাখির যেমন দুর্দিন, তেমনই দুর্দিন ‘অট্টালিকা ’পরে মহাসুখে
থাকা’ চড়ুইয়েরও। রাজধানীতে সড়কদ্বীপে বা বিভাজকে থাকা বকুলের শাখায় সন্ধ্যায় চড়ুইদের
কিচিরমিচির শোনা গেলেও, প্রজনন ঋতুতে তাদের ভারী বিপদ। ডিম পাড়া এবং ছানাদের বড় করতে
তাদের চাই অট্টালিকা। ছাদের কার্নিশে, বারান্দায়-ঘুলঘুলিতে বা ভেন্টিলেটরের ফাঁকে তারা
নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। আজ তো ভেন্টিলেটরেরই দিন শেষ! কাক-চড়ুইয়ের মতো আবাসিক পাখিরাই
নয়, কমছে পরিযায়ী পাখিও। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন, তেমনি
প্রয়োজন পাখিরও। সম্প্রতি এভিয়ান কনজারভেশন অ্যান্ড ইকোলজি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ৬৯ প্রজাতির জলচর পাখির প্রায় ৫৯ শতাংশ প্রজাতি দ্রুত হারে কমে
গেছে। এর বেশির ভাগই পরিযায়ী। পরিযায়ী পাখি কমে যাওয়া মানে তাদেরও আবাসস্থল সংকটে পড়েছে।
আবাসন সংকট আজ
শুধু মানুষের নয়, এ সংকট প্রাণিকুলের সবার। হাতির দলের লোকালয়ে চলে আসা, ফাঁদে মৃত্যু,
মানুষে-হাতিতে লড়াইÑ এও তো আবাসন সংকট থেকেই। বনের বাঘের লোকালয়ে ঢুকে পড়ার পেছনেও
সেই সংকট। ট্রাকের পেছনে চেপে হনুমানের এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরের কাহিনীও
পত্রপত্রিকায় হারহামেশা। আমরা নগরায়ণের দিকে গুরুত্ব দিয়েছি। গাছ কেটে নগরায়ণে ঝুঁকছি।
খোলা জায়গা ভরাট করে উঁচু উঁচু দরদালানের ভিড়ে মুখ লুকাচ্ছি। তা হলে পাখিরা বাসা বাঁধবে
কোথায়? নগরায়ণের নামে গাছে কেটে, আমরা দ্বিগুণ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিচ্ছি। অথচ একটি
গাছের বেড়ে উঠতে কত বছর লাগে, তা কী আমরা হিসাব করছি? যে গাছকে ঘিরে প্রাণ-প্রকৃতি
বেঁচে উঠবে, সবুজ হয়ে উঠবে, তেমন গাছ কি এক দিনে, এক বছরে সম্ভব? সৌন্দর্য বর্ধনের
নামে যেসব গাছ লাগাচ্ছি, তা কি পাখির আশ্রয় হতে পারে? উঁচু গাছে যেসব পাখির আবাস, তারা
কোথায় যাবে? আমরা গাছ লাগাচ্ছি, অথচ পাখি খেতে পারেÑ এমন ফলের গাছ কোথায়? তা কি আমরা
কেউ লাগাই? বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে কাঠ উৎপাদনে সক্ষম বা নিজেদের খাবার উপযোগী ফল গাছের
দিকেই আমাদের নজর। পুকুরে মাছ চাষ করি, সে পুকুরের পুরোটা থাকে জাল দিয়ে ঘেরা। কারণ,
পাখি মাছ খাবে, তার মাছ খাওয়া বারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের যে শঙ্কার কথা বিজ্ঞানীরা বলে আসছিলেন, তার প্রভাব তো চোখের সামনে। প্রকৃতির কখনও রূদ্ররূপ, কখনও বৈরী আচরণ, ঋতুবৈচিত্র্য পাল্টে যাওয়াÑএর সবই তো সেই অশনি সংকেত। যাকে আরও স্পষ্ট করছে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়াও। পাখির নিরাপত্তা নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ হচ্ছে, কিছু সংস্থাও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রয়েছে কিছু সংগঠন, তবে খুব বেশি সরকারি উদ্যোগ নেই। পাখি রক্ষায় আইন আছে, তার প্রয়োগ কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ বিষয়গুলোও ভাবা দরকার। পৃথিবীতে সব প্রাণীরই রয়েছে সমান অধিকার, আমাদের স্বার্থে অন্যদের জীবন বিপন্ন করার অধিকারও আমাদের নেই। মানবেতিহাসের অগ্রগতিতে আজ যা আমরা মহার্ঘ ভাবছি, তাও যে আগামীর জন্য অশনি সংকেত হতে পারে সে দৃষ্টান্তও তো বিজ্ঞানীরা হাজির করেছেন। তা হলে কেন এত বিরূপ মনোভাব? কেন প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করে সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার মহোৎসব?