× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি নিতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান

প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৩ ১৩:১৮ পিএম

আপডেট : ১৭ মে ২০২৩ ০৯:৪৪ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের। সে তুলনায় অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা ব্যতিক্রম। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ধরনে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। অস্বাভাবিকতা বুঝতে হলে বিগত দুই-তিন দশকে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা এবং তীব্রতা যাচাই করতে হয়। বিগত চল্লিশ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দেশে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় দেখা দিচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হওয়ার মধ্যবর্তী বিরতির সময়ও হ্রাস পাচ্ছে। নিকট অতীতে সিডর হয়েছে। আবার সত্তরের দিকেও ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। বিগত দুই দশকে দেখা গেছে পাঁচ বা ছয় বছর পর বড় ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। এখন প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ এটি।  

ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হওয়ার একটি বড় কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। পাহাড়ের বরফ গলে সমুদ্রে মিশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। লোনা পানি আমাদের নদ-নদীগুলোতে মিশে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে। বিশেষত দেশের দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে বিস্তৃত অঞ্চলে মাটির নিচে লবণাক্ত পানি ঢুকে যেতে শুরু করেছে। এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কাজ করার পরিসর সীমিত। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তো একা একটি দেশের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে এর পেছনে দায়ী। এক্ষেত্রে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে পারি। অবশ্য এ বিষয়ে সব সময়ই বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আবার নতুন ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আনতেও দেখা যায়। অথচ প্রতিবারই দেখা যায় এই পদক্ষেপগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে? সেটি বোঝার আগে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রস্তুতির দিকে চোখ ফেরানো যাক।

চট্টগ্রাম প্রশাসন দাবি করছেÑ ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় তাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ১৩ মে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেন্টমার্টিনে কোনো ধরনের নির্দেশনা বা প্রশাসনিক তৎপরতা নেই। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমরা কতদূর এগিয়ে আছি। সচরাচর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা কিংবা উদ্যোগ নেওয়া হয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় কিংবা সিডরের ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করে উপকূলীয় অঞ্চলে কীভাবে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় তার একটি খসড়া ধারণা আমরা নিয়েছি। সিডরের ক্ষেত্রে সাইক্লোন শেল্টারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগের ভয়াবহতা ও গতি-প্রকৃতিও গেছে বদলে। এই মুহূর্তে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার বিষয়টিকে পর্যবেক্ষণ করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমানোর কাজ করতে হলে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। কিন্তু আমরা একা এই কাজ করতে পারব না। তাই দুর্যোগের ক্ষেত্রে আমাদের জননিরাপত্তা ও তাদের সহায়-সম্বলের নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। কারণ দুর্যোগ হলে তো আর আমরা ঠেকাতে পারব না।

ঘূর্ণিঝড় মোখাই নয়, পরবর্তী যেকোনো দুর্যোগের ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি লাঘবের প্রকৌশলগত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় যখন আঘাত হানবে তখন যেন আমাদের অবকাঠামো, ভৌগোলিক অবস্থান সহনীয় পর্যায়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ আমাদের পরিবেশকে দুর্যোগের তীব্রতার সঙ্গে অভিযোজন করতে হবে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার দরুন উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে, কী ধরনের উপকরণ বা প্রকৌশলগত পদ্ধতি ব্যবহার করলে বাঁধ ঘূর্ণিঝড় বা ভাঙন সহনশীল হবে। দুঃখের বিষয়, এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক কোনো কার্যক্রমই আমাদের দেশে হয় না। সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন নয়। অথচ আমরা যদি নেদারল্যান্ডসের দিকে তাকাই দেখব তারা বহু আগে থেকেই সমুদ্রপৃষ্ঠের বেশ নিচে। প্রবল ঝুঁকিতে থাকা দেশটি বাঁধ দিয়ে তাদের ভূমি রক্ষা করছে। আমাদের পরিস্থিতি এমন না হলেও ভবিষ্যতে এমনটি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এটি একটি ছোট উদাহরণ। দুর্যোগ মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনার সব ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।

প্রশ্ন হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় আমাদের কী করার আছে বা ছিলো। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলার কার্যক্রমকে দুর্যোগপূর্ববর্তী, দুর্যোগমধ্যবর্তী এবং দুর্যোগপরবর্তী এই তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই তিনটি ভাগই মূলত প্রস্তুতিমূলক। দুর্যোগপূর্ববর্তী কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদি হয়। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূখণ্ড, মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উন্নত প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়। নিকট অতীতে আমরা দুর্যোগ মোকাবিলায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দেখেছি। কিন্তু এসব প্রযুক্তি শেষ পর্যন্ত কোনো কাজেই আসেনি। অথচ আমাদের নদীগুলোতে লবণাক্ত পানির পরিমাণ বাড়ছে। এসব কারণে জনস্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কার সঙ্গে বড় পরিসরে একাধিক জটিলতা জড়িয়ে থাকে, যা দুর্যোগপরবর্তী সময়ে ভাবতে হয়। দুর্যোগমধ্যবর্তী সময়ে নিয়মিত সতর্কসংকেত দেওয়া এবং মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানোর ব্যবস্থায় তৎপর হতে হয়। দুর্যোগপরবর্তী সময়ে আগের অভিজ্ঞতা থেকে আরও উন্নত ও সহজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে।

দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই অন্য দেশের দিকে তাকাই। বিষয়টি ভুল তা নয়। কিন্তু অন্য দেশের প্র্যাকটিসকে হুবহু এখানে বসিয়ে দেওয়াটা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়। আমাদের ভূ-প্রকৃতি, মানুষের জীবন, অবকাঠামো, প্রকৃতির রূপভেদ ইত্যাদি বিবেচনা করে ওই প্রযুক্তিকে খাপ খাওয়াতে হবে। প্রযুক্তি তখনই আশীর্বাদ হয় যখন তা খাপ খাওয়াতে সক্ষম হয়। ষাটের দশকের পর অনেক জায়গায় বাঁধ গড়ে তোলা হয়েছিল। বন্যার পানি যেন ঢুকতে না পারে, সেজন্য স্লুইসগেট তৈরি করা হয়েছিল। পরে স্লুইসগেট আমাদের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্লুইসগেটের উদ্দেশ্য তো সফল হয়ইনি, উল্টো ওই এলাকায় বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা হয়ে টিকে ছিল। অর্থাৎ দুর্যোগপরবর্তী সময়ের পরিকল্পনা অনেক জরুরি। একটু ভুল হলে তা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এজন্য বিশেষায়িত বিভাগ রয়েছে এবং এসব পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞদের ডেকে আনা হয়। তবে অধিকাংশ সময়ে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের আনা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল না থেকে দেশের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই ভূখণ্ডের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারাই এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো সমাধান বের করে দিতে পারবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিভাগের গবেষকদের সংযুক্ত করা গেলে একটি ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় মোখা ইতোমধ্যে আমাদের সীমানা ছুঁয়ে গেছে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে আমাদের সামনে থাকে ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগপরবর্তী পরিকল্পনার বিষয়। কারণ ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ আমাদের খুব বেশি ক্ষতি না করলেও বৃষ্টিপাত হবে প্রচুর। আর বৃষ্টিপাত হলে ভূমিধসের আশঙ্কা সর্বাধিক। পার্বত্য অঞ্চলের শিলাগুলো প্রচুর নরম। আর এসব এলাকা এত দুর্গম যে সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন। ভূমিধ্স হলে তাই পার্বত্য অঞ্চলে এই ঝুঁকিটি থেকে যায়। একটি দুর্যোগ প্রায়ই আরেক দুর্যোগকে ডেকে আনে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা সময়মত বাস্তবায়নের ফলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। তাই আমাদের সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই আমরা ঘূর্ণিঝড় মোখার ভয়াবহতার আশঙ্কাকে সংযত করতে পারব। আর এই দুর্যোগের বিষয়টি এখন থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সামনে আরও দুর্যোগ আসছে এবং এই দুর্যোগকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। 


  • চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা