সাখাওয়াত হোসেন
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৩ ১০:৫২ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
বিগত কয়েক বছরে সরকার সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নবাদী জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। দুর্গম পাহাড়ে আত্মগোপন করা জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান বাড়ানো হয়েছে এবং জঙ্গিরাও এখন আর পাহাড়কে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ দমনে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। আমরা জানি, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করার মাধ্যমে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে। তরুণ প্রজন্মের মানসিক হতাশা, অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা রিক্রুটিং করে। পূর্বতন অনেক ঘটনায় দেখা যায়, হতাশায় কিংবা ক্ষোভ থেকে অনেক তরুণ সন্ত্রাসবাদের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে তরুণদের একটি বড় অংশ চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হচ্ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আইসিটি খাতে ফ্রি ল্যান্সিংয়ে বহু তরুণের কর্মসংস্থান হচ্ছে, দেশীয় অর্থনীতিতে তরুণরা ভূমিকা রাখছে। শুধু সন্ত্রাসবাদ নয়, যেকোনো ধরনের অপরাধপ্রবণতা থেকে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশকে নিরাপদে রাখতে এ ধরনের যুগোপযোগী উদ্যোগ ও ইতিবাচক পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে এবং এর ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের আস্ফালন নেই, ঘটছে না কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। সন্ত্রাসবাদ দমনে সরকারের আন্তরিকতার ফলাফল পাওয়া গেছে গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সে।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস (আইইপি), গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স (জিটিআই)-২০২৩ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে বাংলাদেশ তিন ধাপ উন্নতি করেছে। অর্থাৎ দেশে সন্ত্রাসবাদ আরও কমেছে এবং দেশ আরও নিরাপদ হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটানের পরই সবচেয়ে নিরাপদ এখন বাংলাদেশ। শুধু তা- ই নয়, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারতের চেয়েও বাংলাদেশ নিরাপদ। আগেরবার বাংলাদেশ ছিল ৪০ নম্বরে। কিন্তু চলতি বছর তিন ধাপ এগিয়ে তা ৪৩ হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ দমনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উন্নতি করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। এদিক থেকে বাংলাদেশের আগে আছে নেপাল। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স থেকে জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসকবলিত ১০টি দেশের দুটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। দেশ দুটো হলো- আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। এর মধ্যে আফগানিস্তান বৈশ্বিক তালিকায় এক নম্বরে, পাকিস্তান ছয় নম্বরে রয়েছে। সন্ত্রাসবাদ থেকে সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর একটি ভুটানও দক্ষিণ এশিয়ার। দেশটিতে বিগত পাঁচ বছরে কোনো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেনি। ভুটানের স্কোর শূন্য। এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এদিকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় উন্নতি করা দেশগুলোর দুটিও দক্ষিণ এশিয়ার। এই দেশ দুটি হলো- বাংলাদেশ ও নেপাল।
তরুণদের মধ্যে হতাশা, না পাওয়ার বেদনা, নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেওয়া চরিত্রের তরুণদের সন্ত্রাসবাদে আকৃষ্ট হওয়ার পূর্বতন ইতিহাস রয়েছে। বর্তমানে সরকারের বহুমুখী উদ্যোগের কারণে তরুণরা পথচ্যুত হচ্ছে না, বিপদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিয়মিত চাকরির বিজ্ঞাপন হচ্ছে, মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ সম্পন্ন হচ্ছে। এ জাতীয় বিষয়গুলো তরুণদের মধ্যে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করছে। পাঠ্যপুস্তকে সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহতা ও সন্ত্রাসবাদের নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে নানাভাবে সচেতন ও সতর্ক করার ব্যাপারে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের সব থেকে বড় সফলতা- সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিষয়টাকে সাধারণ মানুষ ঘৃণার চোখে দেখছে।
আমরা জানি, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকার 'শূন্য সহিষ্ণুতা' নীতি অবলম্বন করছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেই সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। এ ক্ষেত্রে ইন্টেলিজেন্সি উইংকে শক্তিশালী করার জন্য যুগোপযোগী পরিকল্পনা নিয়েছে। এককালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মানুষের মনে ত্রাসের সঞ্চার করলেও এখন অনেক কমেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘন ঘন অভিযান এবং এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের বিষয় জনমনে আস্থা জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকদের ডাটাবেইজ বিভিন্নভাবে সংরক্ষিত থাকায় মেট্রোপলিটান সিটিতে ভাড়াটিয়াদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানাগুলো উদ্যোগ নিতে পারে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেশের অগ্রগতিতে স্থানীয় পর্যায়েও বিশেষ করে ইউনিয়নভিত্তিক জনসাধারণের তথ্য-উপাত্ত ইউনিয়ন পরিষদের নিকট সংরক্ষিত করা হচ্ছে। আবার সরকারের গৃহীত উদ্যোগের কারণে কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং কার্যাক্রম সচল থাকায় যেকোনো নাগরিকের তথ্য মুহূর্তেই বের করা সম্ভব। অজ্ঞাত কারণবশত কেউ নিখোঁজ হলে এখন সহজেই তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। স্মরণে আছে, চলতি বছরের শুরুতে বেশ কয়েকটি জায়গায় তরুণরা নিখোঁজ হয়েছিলেন।জানা যায়, পাহাড়ে আত্মগোপনকারী জঙ্গি সংগঠনের রিক্রুটিংয়ের ফাঁদে পড়ে তারা প্রশিক্ষণ নিতে নিখোঁজ হয়েছেন। সরকারের ইন্টেলিজেন্সি উইং এ জায়গাগুলোতে ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়ে নিখোঁজ হওয়া ছেলেদের উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতাও গড়ে উঠেছে। আস্থা বাড়ায় জনগণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জঙ্গি তৎপরতার খবর পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে জঙ্গি সংগঠন হামলার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তর হচ্ছে এবং জনগণের নিকট সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের বার্তাও সহজে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো আজ তাই প্রশংসিত। তবে এখনও বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কারণ দুর্গম পাহাড়ে এই জঙ্গি সংগঠনগুলো আর নিরাপদ নয়। তারা সমতলে আসতে শুরু করছে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিতে হবে। কারণ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন সময়ে সময়ে তাদের পরিকল্পনায় রদবদল আনে। সন্ত্রাসবাদ দমনেও তাই প্রয়োজন সময়ের সঙ্গে চলমান থাকা।