× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শ্রদ্ধা

ও আলোর পথযাত্রী...

মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:৩৯ পিএম

আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:২৯ পিএম

শিক্ষাবিদ গোলাম কিবরিয়া।                               ছবি : সৈয়দ মুনজের হোসেন বাবু

শিক্ষাবিদ গোলাম কিবরিয়া। ছবি : সৈয়দ মুনজের হোসেন বাবু

স্বপ্নের আকাশে তিনি উদিত হয়েছিলেন ভোরের সূর্যের মতো। অন্ধকার ভেদ করে বেতস পাতার বনে ছড়িয়ে পড়া আলোকরশ্মির মতো। দিন-তারিখ এখন আর মনে নেই, তবে সালটা বোধ হয় ১৯৮১-৮২ হবে। মেজোভাই বিয়ানীবাজার কলেজে একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার মুখেই শোনা নাম--গোলাম কিবরিয়া। 

হাফপ্যান্ট পরা ছাড়িনি তখনও, এর মধ্যেই নামটি মাথায় বেশ গেঁথে গেল। 

কেন গেঁথে গেল? 

গোলাম কিবরিয়া বিয়ানীবাজারের প্রথম শিক্ষার্থী, যিনি অজপাড়ার একটি কলেজ থেকে তার দল নিয়ে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। অনেকটা বিদ্যুৎবিহীন বিয়ানীবাজার এলাকায় টেলিভিশন দেখা তখনও খুব একটা শুরু হয়নি। আমাদের গ্রামে তো হয়ইনি। তারপরও ঘটনাটি ছড়িয়ে গেল সবার মুখে মুখে। আর গোলাম কিবরিয়াও হয়ে উঠলেন সময়ের নায়ক।

বছরখানেক পরের আরেকটি ঘটনা, বিয়ানীবাজার কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সমাপনী দিনে মেজোভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছি তার বাইসাইকেলে চড়ে। দেখলাম লং জাম্প চলছে। প্রথম হলেন দীর্ঘদেহী একজন প্রতিযোগী। যিনি শুধু জাম্প দেন না, শেষদিকে গিয়ে হাতকে ডানা বানিয়ে পাখির মতো একটু উড়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। এই উড়ে যাওয়ার চেষ্টায় তার জাম্প প্রলম্বিত হয়। সবার চেয়ে এগিয়ে যান তিনি। 

‘এই সেই গোলাম কিবরিয়া।’

মেজোভাই কানে কানে পরিচয়টা জানিয়ে দেন। 

বিস্ময় আরও দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তিনি শুধু বিতার্কিক নন, অ্যাথলেটও। 

শুধু বিভিন্ন পর্বে প্রথম নয়, দেখলাম বিকালে তিনি সেরা অ্যাথলেটেরও পুরস্কার নিলেন। 

শিশু-কিশোর মনে তার জন্য একটি স্থায়ী আসন পাতা হয়ে গেল। মনে পড়ে, ছোটদেশ গ্রামে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে সেই ছোটবেলাতেই গোলাম কিবরিয়ার বাড়ি গিয়েছিলাম একবার। যদিও কথা বলার সাহস পাইনি। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় জেলাপর্যায়ে শিশু একাডেমির জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতার বিতর্ক এবং উপস্থিত বক্তৃতা পর্বে অংশ নিয়ে পুরস্কার জেতার পেছনেও মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন গোলাম কিবরিয়া, এটা কি তিনি কোনো দিন জানতেন? জানার কথাও তো নয়। বিশিষ্টজন বা মেধাবীরা নিজেরা জানেন না কতভাবে তারা অনুপ্রেরণার উৎস হন, কতভাবে ডালপালা বিস্তার করে থাকেন সমাজে, মানুষের মনে।

২. 

গোলাম কিবরিয়ার প্রকৃত সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয় ১৯৮৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর। বলা বাহুল্য, হাই স্কুল পর্যায় থেকেই মাথায় ঢুকে গেছে শিল্প-সাহিত্যের পোকা। পত্রিকায় লেখা প্রকাশও শুরু হয়েছে ততদিনে। পরিচিত হয়ে উঠেছে বিয়ানীবাজারের সাহিত্য সংস্কৃতির বারান্দা। এসব কেন্দ্রিক আড্ডার সদস্য হওয়ারও সুযোগ হয়েছে সিনিয়রদের ব্যাপক আনুকূল্যে। চমচমের আড্ডায় গিয়ে আবার পেলাম গোলাম কিবরিয়াকে। ততদিনে তিনি সবার কিবরিয়া ভাই। পরিণত এক যুবক। তার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা হলো পিএইচজি হাই স্কুলে একটি স্বরচিত লেখা পাঠের আসরে গিয়ে। মনে পড়ে, ‘এ সমাজ ভাঙতে হবে’ এ রকম শিরোনামের একটি ‘সমাজতান্ত্রিক’ কবিতা পড়েছিলাম সেখানে। কবিতা পড়ার পরে স্বপ্রণোদিত হয়ে দুজন অগ্রজ আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে এসেছিলেন। তার একজন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক তাজুল মোহাম্মদ আর অন্যজন গোলাম কিবরিয়া। তাজুল ভাই করলেন কবিতার প্রশংসা আর কিবরিয়া ভাই কীভাবে সমাজ বদলাতে হয়, তার লেসন দিলেন পরবর্তী কয়েকদিন। স্বাধিকার খেলাঘর আসরের সক্রিয় সদস্যও হয়ে উঠলাম অল্প কিছুদিন পর। 

এসএসসির ফল বেরিয়ে গেছে। বিয়ানীবাজার কলেজে ভর্তি হয়েছি। এবার কিবরিয়া ভাইকে পেলাম শিক্ষক হিসেবে। তিনি আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতে শুরু করলেন। কী অসাধারণ পাঠদান! বুঝতে পারলাম, জীবনে বড় হতে হলে, সামনে এগিয়ে যেতে হলে এ রকম মানুষের সান্নিধ্যে থাকা খুব বেশি জরুরি। 

উপজেলা পর্যায় থেকে সাংবাদিকতাও শুরু হয়ে গেছে। সম্পাদনা করছি সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘উদ্দীপন’। শুধু চমচম নয়, আড্ডা বিস্তৃত হয়েছে গোলাবিয়া লাইব্রেরি, আলআমীন প্রেস, কনক প্রেস, বকুল হোটেল ইত্যাদিতে। শাণিত হতে থাকল আমাদের যূথবদ্ধ পথচলাও। অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এগুলোও তখন আস্তে আস্তে মাথায় ঢুকতে শুরু করেছে। এগুলোর পেছনে কারা? অবশ্যই পেছনের কারিগরদের অন্যতম গোলাম কিবরিয়া। আঁধারের পথে তিনি যে আলোর পথযাত্রী। মুখে স্যার ডাকা শুরু করলেও তিনি রইলেন অগ্রজ প্রিয়জন হিসেবেই। ঠিক ছাত্র-শিক্ষক নয়, যোগাযোগটাও হয়ে উঠল নানামাত্রিক। 

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন জমে উঠেছে। আমরা তখন মিছিলের মুখ। লক্ষ করছি, সেখানেও অংশগ্রহণ আছে গোলাম কিবরিয়ার। এখানে তিনি বামধারার রাজনীতিক। সিপিবি নেতা। একাধারে অনেকভাবেই নিজেকে নির্মাণ করেছেন এই প্রিয়জন। একেবারে স্ব-উদ্যোগে। হার-না-মানা এক অদম্য চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য তাকে সব সময় সামনে এগিয়ে দিয়েছে। 

৩. 

১৯৯১ সালে বিয়ানীবাজার ছেড়েছি। সিলেট শহর হয়ে থিতু হয়েছি রাজধানীতে। আমাদের ছেড়ে আসার আগেই বিয়ানীবাজার কলেজ সরকারি হয়ে গেছে। শুরুতে গোলাম কিবরিয়ার চাকরি কিছুটা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লেও পরবর্তীতে কেটে গেছে সব কালো মেঘ। বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ ছাড়াও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। সবশেষে অবসরে গেছেন সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে। দেখা-সাক্ষাৎ বছরে একবার-দুবারের বেশি না হলেও আমাদের আত্মিক যোগাযোগটা সার্বক্ষণিকই থেকে গেল। 

২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট। সমকালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছি। স্যারের উচ্ছ্বসিত ফোন, ‘আবেগে আমি কথা বলতে পারছি না মুস্তাফিজ। ভাবা যায়, আমার সরাসরি ছাত্র আজ প্রধান একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক।’ 

বললেন, ‘স্বপ্ন দেখতে দেখতে জীবনটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন তোমাদের পালা। আশা করছি, তুমি অনেক দূর যাবে। আমাদের সবার মুখ আরও আলোকিত করবে। বিয়ানীবাজার থেকে ঢাকা, বাস্তবায়নের অপেক্ষায় অনেক স্বপ্ন আছে তোমার সঙ্গে।’ 

ক্যান্সার তার জীবনের গতি থামিয়ে দিচ্ছে, এ কথাও বললেন কয়েকবার। 

কী বলব। সান্ত্বনাই দিয়েছি। কোথায় কোথায় এর কার্যকর চিকিৎসা আছে, সেগুলোও জানিয়েছি। কারা কারা ক্যান্সার জয় করেছেন, আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে তাদের নামও। 

এরপর যতবারই দেখা অথবা টেলিফোনে কথা হয়েছে, তার বড় অংশই ছিল ক্যান্সার নিয়ে। প্রতিবারই বলেছি মনোবল শক্ত রাখতে। বলেছি, আপনি আমাদের আলোর পথযাত্রী, আপনি অন্ধকারে হারাতে পারেন না।

২০২০ সাল। ঈদুল আজহায় গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। করোনার কারণে এবার খুব একটা বের হইনি। স্যারও সিলেট থেকে বিয়ানীবাজার যাননি। দেখাও হয়নি তাই। ফিরতি পথে ফোন পেলাম, ‘মুস্তাফিজ, আমার শরীরটা খুর খারাপ। তোমাকে দেখতে মন চাচ্ছে। আগামী মাসে ঢাকায় আসব, অবশ্যই দেখা করো।’

স্যার ঢাকায় এলেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে আবার শুরু হবে কেমো। রেস্টহাউসে গেলাম দেখা করতে। সঙ্গে উপস্থিত স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘শারীরিক এই অবস্থার মধ্যেও প্রতিদিন তোমার পত্রিকা দেখার চেষ্টা করি। প্রথমেই তাকাই শেষ পাতায় প্রিন্টার্স লাইনের দিকে। তুমি ভারমুক্ত হয়েছ সেটা দেখার আশায়।’ 

কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে স্যারের। মনটা আর্দ্র হয়ে আসে। কী বলব আমি?

হাসপাতাল থেকে স্যার সিলেটে ফিরে গেলেন। অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্য আবার দেশের বাইরে গেলেন। আর দেখা হয়নি। স্যারের স্মারকগ্রন্থ বের হলো। সেখানে দেওয়া লেখাটি শেষ করলাম এভাবে--আমরা যে অদম্য গোলাম কিবরিয়াকে দেখে দেখে বড় হয়েছি, তিনি এভাবে ক্যান্সারের কাছে হার মানতে পারেন না। তার জীবনের গল্পে এই হার মানা পর্বটি যুক্ত হতে পারে না। 

রবীন্দ্রনাথের বহুল প্রচলিত কয়েকটি লাইনও জুড়ে দিয়েছিলাম সেখানে--

‘এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয়, তোমারি হউক জয়। 

প্রভাতসূর্য এসেছ রুদ্রসাজে 

দুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজে, 

অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে, মুত্যুর হোক লয়। 

তোমারি হউক জয়।’

কিন্তু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অদম্য গোলাম কিবরিয়া জয়ী হননি। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২-এর এক সন্ধ্যায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে। জানার পর সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। বারবারই মনে হচ্ছিল, ব্যক্তি গোলাম কিবরিয়া অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও তার দেখানো পথ আমাদের সামনে বাতিঘর হয়েই থাকবে। শুধু আমরা নই, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হাঁটতে থাকবে সেই আলোর পথে। অন্ধকারে আপনি আলো হয়েই থাকবেন ‘ও আলোর পথযাত্রী’।


মুস্তাফিজ শফি : সাংবাদিক-লেখক। সম্পাদক-প্রতিদিনের বাংলাদেশ। গোলাম কিবরিয়ার সরাসরি ছাত্র। [email protected]




শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা