× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সোমেশ্বরীর প্রাণ ওষ্ঠাগত

মো. অহিদুর রহমান

প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৫৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিষ্ণুবীছড়া, রাঙাছড়া রমফা নদীর জলধারা মিলে উৎপত্তি সোমেশ্বরীর। গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে নেমে আসা অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরা ইতিহাস-ঐতিহ্যে বিখ্যাত টংক আন্দোলনের যোদ্ধা হাজং মাতা রাশিমনি হাজংয়ের রক্তে স্নাত টংকযোদ্ধা কুমুদিনী হাজংয়ের নির্যাতনের সাক্ষী ইতিহাসখ্যাত নদী সোমেশ্বরী। বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী এই পাহাড়ি কন্যা বলে খ্যাত সোমেশ্বরী। বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে দুর্গাপুরের রানীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে। বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ১১৪ মিটার।

সোমেশ্বরী এখন লাভ ও লোভের জায়গা। সোমেশ্বরীর প্রাণ এ কারণে ওষ্ঠাগত। ওখানে শুধু বালু নিয়ে ব্যবসার খেলা। সোমেশ্বরী এখন বালুমহাল। ট্রাকের পর ট্রাকের লাইনে যেন দিন-রাত বালু উত্তোলনের উৎসব। নিয়মবহির্ভূত বালু উত্তোলন করার কারণে পরিবেশ-প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য-কৃষিব্যবস্থা ও মৎসসম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। শত শত ড্রেজারের প্রপেলারের আঘাত, নির্গত পোড়া মবিল ও তেলের কারণে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিজসম্পদ বিলুপ্তপ্রায়। বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে সোমেশ্বরীর মহাশোল প্রাপ্তি এখন ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোমেশ্বরী পাহাড়ি ঝরনা থেকে প্রবহমান হওয়ায় জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তন ও অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে নদীর স্বাভাবিক গতি এখন আর নেই। আমরা শুধু নদীর কান্না শুনতে পাই। নীরব কান্না। সোমেশ্বরী কেন বালুমহাল হলো? সোমেশ্বরী নদীতে সরকার ঘোষিত বালুমহাল রয়েছে পাঁচটি। সেগুলো হচ্ছেÑ বিজয়পুর ভবানীপুর থেকে দুর্গাপুরের তেরীবাজার ঘাট হয়ে শিবগঞ্জ বাজার ঘাট পর্যন্ত, শিবগঞ্জ বাজারঘাট থেকে চৈতাটী, দুর্গাপুর বিরিশিরি ঘাট থেকে কেরনখলা, গাঁওকান্দিয়া মৌজার উত্তর সীমানা থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বালুমহাল এবং ঝাঞ্জাইল থেকে উত্তর শংকরপুর পর্যন্ত বালুমহাল প্রতিবছর চৈত্র মাসে ইজারার জন্য বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এর আইন অনুসারে কার্য সম্পাদিত হয়ে থাকে।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা অনুযায়ী পাম্প, ড্রেজার বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন করা যাবে না। নিয়ম হলো, বালুমহাল থেকে কতটা বালু তোলা হবে তা সমীক্ষা করে নিতে হবে,বালু উত্তোলনে সাকশন ড্রেজার ব্যবহার করতে হবে; যাতে নদীতে সুইং করে তলদেশে সমভাবে খনন করা যায়। কিন্তু দেখা গেছে ৭০০-৮০০ অবৈধ ড্রেজার দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে সোমেশ্বরীর বুকে ক্ষত করে। ফলে নদীর বিভিন্ন স্থানে তৈরি হচ্ছে বড় বড় গর্ত। এসব গর্তের চারপাশ ভেঙে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ। বালুর পাশাপাশি নদীর তলদেশ থেকে উঠানো হচ্ছে নুড়ি; কিন্তু পাথর উঠানোর জন্য সরকারি কোনো আদেশ বা কোনো নিয়ম নেই। এ ছাড়া ড্রেজার থেকে নির্গত মবিল নদীর পানিতে মিশে মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে। নদীর তলদেশ থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। আশপাশের গ্রামের টিউবওয়েলগুলোতে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পানি ওঠে না। ৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দুর্গাপুর শহররক্ষা বাঁধ আজ হুমকির মুখে। ২০১৬ সালে ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্যামগঞ্জ-জারিয়া-বিরিশিরি সড়ক তৈরি হলেও ভিজা বালি বহন করার ফলে নষ্ট হয়ে গেছে।

সোমেশ্বরীর অবস্থা সংকটাপন্ন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য যেমন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের মানুষজন। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে আছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য,জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বালু উত্তোলন করা যাবে না, আইনে তা সুস্পষ্ট। কিন্তু আইনের কোনো তোয়াক্কা করছেন না ইজারাদাররা? বাংলাদেশে মহাশোলের দুটি প্রজাতি ছিল। ‘সোনালী মহাশোল’ এবং ‘লাল-পাখনা মহাশোল’। আর একটি প্রজাতি নতুন করে পাওয়া গেছে বান্দরবানের থানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর আন্দারমানিক, বড়মোদক ও লিগরি এলাকায়Ñ যেখানে পানির গভীরতা এবং তলদেশে পাথরের পরিমাণ বেশি, সেখানে নতুন প্রজাতির মহাশোল মাছটি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে এ মাছটি ‘ফড়ং’ কিংবা ‘মিকিমাউ’ নামে পরিচিত। বান্দরবান জেলার সাঙ্গু নদীতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা এ প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন। এতে দেশে মিঠাপানির মাছের সংখ্যা হবে ২৬১টি।

বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের অধীনে ২০০৫-২০১৫ সময়ের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিবছরই সোমেশ্বরী নদীতে মাছের ১০-১৫ বার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মৌসুম ও নদীর বিভিন্ন অংশের কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মাছের বিভিন্ন প্রজাতির নাম তাদের এই সময়ের সোমেশ্বরী থেকে ২৯টি পরিবারের অধীনে ১১৫ প্রজাতির মাছ, ৩ প্রজাতির চিংড়ি এবং ১ প্রজাতির কাঁকড়া চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ২০০৫-২০১৫ সময়ের মধ্যবর্তী সময়ে সোমেশ্বরী থেকে ২০০৬ সালে পাওয়া গিয়েছিল ৯৮ প্রজাতির মাছ; কিন্তু ২০১৫ সালে মাত্র ৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালে মাছের সংখ্যা ২৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে।

অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত নদীর মতোই সোমেশ্বরীতেও প্রাণবৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে উজান থেকে ক্রমহ্রাসমান পানির প্রবাহ। নদী ভরাট, পানির দূষণ, অতি আহরণ প্রভৃতি কারণে এই নদীর মৎস্য প্রাণিসম্পদ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। উজানে বাঁধ এবং কম বৃষ্টিপাতÑ এই নদীর অনেক মূল্যবান মাছ হুমকির মুখে। অনেক মাছের মৌসুমি প্রজননের জন্য মাইগ্রেটরি পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এই নদীতে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও চারণভূমি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। নদীর গতি পরিবর্তন, গতিরোধ, প্রবাহ বাধাগ্রস্ত, প্রবাহ বন্ধ, পানি প্রত্যাহার, বাঁধ নির্মাণ করে নদীর গতিকে রোধ করেছি, প্রবাহকে বন্ধ করেছি। নদীকে নদীরূপে থাকতে দিইনি। আমাদের বিবেক আছে, বিবেকের তাড়না নেই। সুমেশ্বরী আমাদের অস্তিত্বের অংশ, আমাদের নান্দনিকতার উৎস। সোমেশ্বরীসহ নেত্রকোণার সব নদীর আত্মহনন বা হত্যা করে আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সচল ধারাকে অবলুপ্ত করতে যারা চাইছে তারা স্বদেশ-জাতির মিত্র নয়। নদীকে নদীর মতো করে থাকতে দিতে হবে। আসুন নদী বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই, আমরা বাঁচি।


  • পরিবেশ কর্মী, আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বারসিক 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা