× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর আশ্বাস

সৈয়দ মাহবুবুর রশীদ

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৩২ পিএম

আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৫৭ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহার সাশ্রয়ের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অন্যতম পদক্ষেপ হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুদিন বন্ধ থাকবে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তর যথা শিক্ষা অধিদপ্তর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বেশ মাথা ঘামাচ্ছে। আসলে এটি কোনো ব্যাপারই নয়। বহু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুদিন ছুটি দিয়ে আসছে। বিশ্ব চলছে পাঁচ কর্মদিবসে। সমস্যাটা সময়ের নয়, কর্মনিষ্ঠা, সমায়নুবর্তিতা এবং আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ। এসব ঠিক থাকলে পাঁচ দিনই যথেষ্ট। এবার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা। তা অনেক উপেক্ষা করে এখন বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চলছে দেশে। খোদ সরকারি বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন চালু করা হয়েছে। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হলো। পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি প্রচলন করা হলো। ছাত্র তো দূরের কথা, শিক্ষকও বোঝেন না সৃজনশীল পদ্ধতিটি কেমন! ফলে বাজারে ঢাউস সাইজের গাইড বই প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিবছর। আর তাতে শিক্ষার মান আরও কমছে।

সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ প্রতি বছর স্কুলে বিনামূল্যে বই বিতরণ। কিন্তু গাইড বই কিনতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তাতে অভিভাবকদের কতটুকু সাশ্রয় হয়েছে এই বিনামূল্যে বই প্রাপ্তিতে, তা হিসাবের ব্যবহার। তবু সরকারের এই উদ্যোগকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এবং গোল্ডেন জিপিএর জন্য শুধু ছাত্রই নয়, অভিভাবকদের মধ্যেও শুরু হয় অস্বাভাবিক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কীভাবে তার সন্তান কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করবেন তার জন্য তাদের চিন্তার অন্ত নেই। কোন গাইড বইয়ে সমাধান ভালোভাবে দেওয়া হয়েছে, কোন গাইড বই পড়লে তার সন্তান পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পাবে, এ নিয়ে অনেক অভিভাবককে সমসময় চিন্তিত দেখায়। এর মধ্যে দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে কোচিং শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। অনেক মা শিশুদের নিয়ে ভোরে নাশতা সঙ্গে করে কোচিং সেন্টারে যান। কোচিং শেষে আবার সন্তানকে নিয়ে যেতে হয় স্কুলে। আবার পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলে স্কুলের ছুটির পরে কোচিং ক্লাস হয় অনেক ক্ষেত্রেই। শিশুদের অবস্থা দেখলে রবীন্দ্রনাথের ‘তোতা কাহিনী’র গল্পের কথা মনে পড়ে। 

শিশুদের চিত্তের বিকাশের সব পথ যেন বন্ধ। লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলার যে যোগসূত্র ছিল তা বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য স্কুল কলেজ পর্যায়ে প্রতি বছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। সেসব অনুষ্ঠানে খেলার মান কিংবা প্রতিযোগিতার কাঠামো নিয়ে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব অনুষ্ঠান বিশেষ অতিথি কিংবা বিশিষ্টজনদের অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজন হিসেবেই বিবেচিত হয়। এমনকি স্কুলের সকল শিক্ষার্থী এসব অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে না। এ ছাড়া সারা বছর স্কুলের মাঠে স্কুলের শিক্ষার্থীদেরই অনেক ক্ষেত্রে প্রবেশ নিষেধ থাকে। এক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনেক ক্ষেত্রে এই যুক্তিও শোনা যায়, মাঠের পরিচর্যা এবং পরিস্থিতি ঠিক রাখতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাহলে স্কুলসংলগ্ন মাঠ থাকার প্রয়োজনটাই বা কী? মাঠের পরিচর্যা করাই হয় যাতে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পায়। কিন্তু খেলাধুলা বন্ধ করে মাঠের পরিচর্যার যুক্তি ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্য অভিভাবকদের সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায়? স্কুল শেষ হলেই তো আবার কোচিং ক্লাস আছে। সেখানে দ্রুত পৌঁছুতে পারলেই হয়। এখন আবার অনেক অভিভাবক কোচিং ক্লাসের জন্য কোনো কোনো দিন স্কুল কামাইয়েও শিক্ষার্থীকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। ঢাকা শহরের খ্যাতনামা সরকারি স্কুলের এ ধরনের অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন অতিথি আনা হয় যেমন প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, গেস্ট অব অনার, ইত্যাদি। বলা বাহুল্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তারাই এসব অনুষ্ঠানে আসেন। জানা গেছে পিএসসি ও জেএসসি নামক দুটো পাবলিক পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পরীক্ষা আর নেওয়া হবে না। তা যদি হয়েও থাকে, তাহলে সেটি হবে একটি মহৎ কাজ। শিশুদের প্রতিনিয়ত ভালো ফল করার প্রস্তুতির যে নির্যাতন সহ্য করতে হয়, তা বন্ধ হবে। কোচিংয়ের বিষয়টি নতুন নয়। আগে সাধারণত যে দুয়েকটি বিষয়ে কোনো ছাত্র একটু বেশি দুর্বল থাকত সে ক্ষেত্রে ওই ছাত্র কিছু দিনের জন্য ওই বিষয়ের জন্য কোচিং কিংবা বিশেষ ক্লাসের সহায়তা নিত। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষা চালু হওয়ায় কোচিং যেন মহামারির রূপ নিয়েছে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও একটি ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। আগামীতে নবম শ্রেণিতে বিষয়ভিত্তিক যে বিভাজন অর্থাৎ বিজ্ঞান, বাণিজ্যিক এবং মানবিক এসব বিভাগ থাকবে না। এই বিভাজনে আরও একটি ভয়াবহ দিক আছে। সরকারিসহ বেশ কিছু নামকরা স্কুলে এখন পর্যন্ত মানবিক বিভাগ চালু হয়নি। আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা হলো কিছু মহাজ্ঞানী ব্যক্তি যদি ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পান বা কাছাকাছি আসেন, তাহলে তিনি যে পেশার লোক হবেন তার চারপাশের মানুষকেও সেই পেশাতেই অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেন। যদি তিনি গণিতে পণ্ডিত হন, তাহলে তার লক্ষ্য হবে সবাইকে গণিতে পণ্ডিত বানানোর। বিজ্ঞানী হলে সবাই বৈজ্ঞানিক হতে হবে এমনটাই যেন তার ভাবনা। এদিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সময় বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসতে পারেন না অনেকেই। অনেক কিছু দেখে এও মনে হয় যেন দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এসব জানার কোনো প্রয়োজন নেই। অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় অনেক কলেজে ইতিহাস বিভাগ নেই। অতি সম্প্রতি একজন অসাধারণ জ্ঞানী দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুবরণকারী এই ব্যক্তিত্ব ড. আকবর আলি খান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র। পরবর্তী সময়ে ড. আকবর আলি খান অর্থনীতিবিদ, দেশপ্রেমিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক এবং মানবতাবাদী এবং স্পষ্টভাষী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেন সুপার পণ্ডিতের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাতে ছাত্ররা অনেক নেতিবাচকতা থেকে রেহাই পাবে।

বঙ্গবন্ধু একমুখী শিক্ষার কথা ভেবে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। স্বাধীন এবং মর্যাদাসম্পন্ন দেশের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রস্তুতের জন্য উক্ত কমিশন সুপারিশ করেছিল। স্বাধীন দেশে শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষার মাহাত্ম্যের সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচিত হতে পারেন এবং জাতিকে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিতে পারেন এই উদ্দেশ্যেই ওই শিক্ষা কমিশন কাজ করে যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যে আদর্শের জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেসব কিছু ধ্বংস করে দেওয়ার হীন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দেশ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা কঠিন হলেও আমরা তাই চাই। বিশ্বায়নের অজুহাতে শিক্ষাব্যবস্থা করপোরেট রূপ নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও শিক্ষার কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য অর্জনের বদলে ভালো ফলাফল ও চাকরির বাজারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতার দিকনির্দেশনার দায়িত্ব নিয়েছে কোচিং কিংবা গাইড বই প্রকাশের মতো অন্যান্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। 

শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর যে আশ্বাস পাওয়া গেছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। অন্তত শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস, কলা, সাহিত্য ও অন্যান্য সুকুমার কলাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এ ছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলার ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যেন বিকৃত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এ দেশকে ভালোভাবে জানতে পারে, তা নিশ্চিত করা আমাদেরই দায়িত্ব। পরিশেষে আবারও বলব, দুদিনের ছুটি বড় সমস্যা নয়। সমস্যা হলো আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবসম্মত করা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনের ভেতরে, সেটি মনে রাখতে হবে। নিকট অতীতে পরিকল্পনামন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে সুন্দর একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘খাইলেন বাংলায়, আলোচনা করলেন বাংলায়, অথচ রিপোর্টটা দিলেন ইংরেজিতে।’ বিশ্বায়নের যুগে অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে যাদের ভালো লাগবে, তারা এই দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশের অভিবাসী হলে আমাদের সমালোচনা করার অবকাশ নেই। বলা যায় এতে ক্ষতিও তেমন নেই। কিন্তু যারা দেশে থাকবেন। ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন, তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে কেন্দ্র করে কোনো অনুষ্ঠান হলে সেখানে কবিবন্দনার চেয়ে আমলাবন্দনা বেশি হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় দুদিন ছুটির ঘোষণা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য যত না বড় সমস্যা তার চেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে চলা অসুস্থ প্রতিযোগিতা। 

লেখক : মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা। ব্যাংক-শেয়ারবাজার ও বীমা খাত বিশ্লেষক। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা