× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কারখানার বর্জ্য দূষণে বন্দি জীবন ও জমিন

পাভেল পার্থ

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:১১ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ফ্রান্ক বি সিমসন শালবন থেকে উপকূলÑ দেশের নানা প্রান্তে বন্যপ্রাণী শিকার করে বেড়িয়েছেন। তার সেই সব নির্মম শিকারকাহিনি লন্ডন থেকে ১৮৮৬ সালে ‘দ্য লেটার্স অন স্পোর্টস ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল’ নামে বিশাল এক বই প্রকাশিত হয়। ওই বইতে বন্যপ্রাণী ভরপুর শালবনের বহু স্মৃতি আছে। মধুপুর ও ভাওয়ালগড়ের গা ছমছম শালবনের বিবরণ আছে। কিন্তু সেই সব শালবন আজ উধাও। বিশেষ করে ভাওয়ালগড়ের শালসভ্যতা খুন করেই গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা। শালবনের চালা ও বাইদ জমিনের বিশেষ ভূমিবিন্যাসকে চুরমার করে। অথচ দেশের ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের ভেতর মধুপুর গড় এক অনন্য কৃষিপ্রতিবেশ এলাকা। বিশেষ করে গার্মেন্টস কারখানার প্রবল বিস্তার ঘটেছে ওই অঞ্চলে। পাশাপাশি সিরামিকস, কাচ, বহুজাতিক কোমল পানীয়, পোল্ট্রি খাদ্য, রাসায়নিক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসহ নানা শিল্পকারখানার ভারে আজ ভাওয়ালগড় রুগ্ন। এসব কারখানার অধিকাংশই পরিবেশ আইন ও নীতি মানছে না।

কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে চারপাশ। গাজীপুরের একটা বিশাল এলাকাজুড়ে বাতাস, মাটি কিংবা পানি সবই আজ রাসায়নিক দূষণে আক্রান্ত। দেখা গেছে বহু শিল্পকারখানা তাদের উৎপাদিত বিপজ্জনক বর্জ্য সরাসরি ফেলছে কৃষিজমিনে কিংবা জলাভূমিতে। নির্দয়ভাবে মরছে মাছ, বন্যপ্রাণ ও জলজ বাস্তুতন্ত্র। প্রতিদিন রাসায়নিক দূষণে বিদীর্ণ হচ্ছে কৃষিজমিন। প্রধানমন্ত্রীর বহুবারের ঘোষণা ‘প্রতি ইঞ্চি জমিনের ব্যবহার’ ভাওয়ালগড়ে চাপা পড়ছে কারখানার বর্জ্যদূষণে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে। বন্যপ্রাণসহ জনস্বাস্থ্যও পড়ছে হুমকিতে। কৃষিনির্ভর উৎপাদন কমছে এবং সহস্র বছরের কৃষিজীবন থেকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হচ্ছে বহু মানুষ। তাতে কেবল খাদ্যনিরাপত্তাই বিঘ্নিত হচ্ছে না, বরং তৈরি হচ্ছে নয়া কর্মসংস্থানের সংকট। পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়কে সামগ্রিক বিবেচনায় রেখেই এই উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করতে হবে। শিল্পকারখানাকে পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জনজীবনের গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা ও কারখানা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

গাজীপুরের শ্রীপুরের রাজাবাড়ী ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর (সাটিয়াবাড়ী) গ্রামে স্থাপিত ‘ডার্ড কম্পোজিট লিমিটেড কারখানার’ তরল বর্জ্য বিনষ্ট করছে স্থানীয় কৃষিজমি ও জলাভূমি। নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল, মরছে মাছ। কারখানার বয়লারের কালো ধোঁয়ায় এলাকাবাসী শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন। ভুক্তভোগী কৃষকরা কয়েক বছর ধরে অভিযোগ জানালেও মিলছে না তার প্রতিকার। ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর কারখানাকে ২৭ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু তার পরও দূষণ বন্ধ হয়নি। আবারও প্রতিকার চেয়ে ধলাদিয়া গ্রামের কৃষক মফিজ উদ্দিন স্থানীয় ভুক্তভোগীদের স্বাক্ষরসংবলিত একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরে। অভিযোগের অনুলিপি পাঠান স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর। কিন্তু তাও দূষণ থামছে না।

ডার্ড কারখানার দূষণ বিষয়ে ‘প্রতিদিনের বাংলাদেশে’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জানায়, কারখানার বর্জ্যে বিলের পানি পচে যাওয়ায় গন্ধে বাজারে ও দোকানে টেকা যায় না, মসজিদে নামাজ পড়তে সমস্যা হয়। ধানের পুষ্পায়নের সময় গোড়া পচে গাছ মরে যায়। বিল থেকে টেংরা, পুঁটি, কৈ, শিং ও দারকিনা মাছ প্রায় বিলুপ্ত। ভুক্তভোগী কৃষকরা জানান, আগে বিঘাপ্রতি ৩০-৩৫ মণ ধান পাওয়া গেলেও এখন দূষিত পানির কারণে ১৫ মণের বেশি ধান পাওয়া যায় না। কারখানার বর্জ্য দূষণে প্রায় এক হাজার জমিতে ফসল ফলানো যাচ্ছে না (দেখুন : প্রবা, ১০/৪/২৩)। স্থানীয় বাসিন্দারা এও জানিয়েছেন, আগে পারুলি নদীতে গোসল করা যেত। গরু-বাছুরকেও গোসল করানো হতো। কিন্তু কারখানার বর্জ্যের কারণে এখন পারুলি নদীতে কেউ নামছে না। ডার্ড কারখানার দূষণ-যন্ত্রণার কথা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন স্থানীয় রাজাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান হাসিনা মমতাজ। পরিবেশ অধিদপ্তরও জানিয়েছেন, তারা ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়েছেন এবং তদন্ত করে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু ডার্ড কারখানা স্থানীয়ভাবে কোনো মন্তব্য না করে এ বিষয়ে হেড অফিসে যোগাযোগ করার কথা বলেন। এর আগে ২০২২ সালেও ডার্ড কারখানার পাইপ দিয়ে বর্জ্যমিশ্রিত পানি কৃষিজমিনে ছড়িয়ে দূষণের চিত্র ও সংবাদ প্রকাশ হয় জাতীয় দৈনিকে। সেই প্রতিবেদনে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছিল, ডার্ড কারখানা পরিবেশ দূষণ করছে এবং ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর কারখানাকে ২৭ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট ডার্ড কারখানার আশপাশের জলাশয়ের পানি পরীক্ষা করে শ্রীপুর উপজেলা মৎস্য কার্যালয়। সেই পানিতে বিপুল অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং পিএইচ মাত্রা কোথাও ১১ এবং কোথাও ১২ পাওয়া যায়। যদিও স্বাভাবিক পানিতে পিএইচ মাত্রা থাকার কথা ৭ থেকে সাড়ে ৭-এর ভেতর। পিএইচ মাত্রা বাড়লে পানিতে ক্ষারের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অ্যামোনিয়া বাড়লে পানিতে অক্সিজেন কমে যায়। এমন পানিতে মাছ, ফাইটোপ্ল্যাংকটন, অণুজীব বা কোনো জলজ প্রাণের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

ডার্ড কারখানা কেবলমাত্র নয়; দেশের নানা এলাকায় শিল্পকারখানার দূষণের মাধ্যমে জলাভূমি ও কৃষিজমির প্রশ্নহীন সর্বনাশ ঘটছে। নওগাঁর ছোট যমুনা নদী এক সময় প্রবহমান থাকলেও এখন একে শহরের প্রধান আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্য শ্রী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ছোট যমুনা নদীকে বিষাক্ত করে তুলেছে। টেংরা, বাইন, বোয়াল ও পুঁটিমাছ মরে ভেসে উঠছে। বদলে গেছে পানির রঙ, ছড়াচ্ছে বিষাক্ত গন্ধ। ময়মনিসংহের ভালুকা অঞ্চলে প্রবাহিত খিরু নদীটি দূষিত হয়েছে এনআর স্পিনিং মিলের বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও আছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, জাতীয় নদীরক্ষা আন্দোলনসহ ১৭টি পরিবেশবাদী সংগঠন বুড়িগঙ্গা নদীদূষণ ও দখলের জন্য শিল্পপতিদের দায়ী করেছিলেন।

ডার্ড কারখানার মতো যেখানেই বনভূমি ও কৃষিজমিতে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, সেখানেই ব্যাপক দূষণ ঘটেছে। শিল্পকারখানার আশপাশের মাটিতে আর্সেনিক, সিসা ও ম্যাঙ্গানিজসহ নানা ধাতুর ক্ষতিকর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে বহু গবেষণায়। বাংলাদেশের পরিবেশবিষয়ক একটি প্রতিবেদন (২০০১) জানায়, দেশে মাটির জৈব উপাদান ভয়াবহভাবে কমছে। কারখানার দূষণে মাটির জৈব উপাদান ক্ষয় হয়। অবশ্যই আমাদের শিল্পকারখানা দরকার। কিন্তু তাই বলে কৃষিজমিন, জলাভূমি, অরণ্য, জনস্বাস্থ্য কিংবা প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস করে নয়।


  • লেখক ও গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা