ড. কবিরুল বাশার
প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:২২ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের কবিতা, ‘দ্য রিম অব দ্য অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’-এর বিখ্যাত লাইন, ‘ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়ার অ্যান্ড নট আ ড্রপ টু ড্রিংক’ (চারদিকে পর্যাপ্ত পানি, কিন্তু খাওয়ার যোগ্য পানি এক ফোঁটাও নেই)। আমরা ছোটবেলায় আরও পড়েছি ‘পানির অপর নাম জীবন’। পানির অপর নাম জীবন বলা হলেও এর অর্থ ছোটবেলায় অনেকেই বুঝিনি। পানির অপর নাম জীবন না বলে কথাটি এমন বললে ভালো হতোÑ ‘বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে পৃথিবীতে বছরে ১.৪ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এবং ৭৪ মিলিয়ন মানুষের আয়ু কমে যায় শুধু দূষিত পানি এবং খারাপ স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে। আর এই রোগ সংক্রমণের মূল কারণ হলো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অপরিশুদ্ধ পানি।
বর্তমানে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (৩.৬ বিলিয়ন)
মানুষের নিরাপদ স্যানিটেশন ও পৃথিবীতে চারজনের একজন (২ মিলিয়ন) নিরাপদ পানির অভাবে
রয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব পানি
উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৪৪ শতাংশ পরিবারের বর্জ্য
পানি নিরাপদে শোধন করা হয় না এবং এগুলো সরাসরি খাল-বিল, নদী-নালায়
গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। পানির এই ভয়াবহ সংকটময় পরিস্থিতিতে গত ২২ থেকে ২৪
মার্চ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে
আয়োজন করা হয় বিশ্বের প্রথম ‘পানি সম্মেলন’। ওই
সম্মেলনে পানি বিশেষজ্ঞ, গবেষক, শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক এবং রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা একত্রিত হন।
সম্মেলনটি পাঁচটি থিমÑ স্বাস্থ্যের জন্য পানি; টেকসই
উন্নয়নের জন্য পানি; জলবায়ু এবং পরিবেশের জন্য
পানি; পানির জন্য সহযোগিতা এবং পানি সমস্যার সমাধানে অ্যাকশন প্ল্যান
বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়। এ ছাড়াও জলাশয় ইতিহাস পরিবর্তন, নদীর
ওপর নৃতাত্ত্বিক হস্তক্ষেপের প্রভাব, পানি
ও নদী অধিকারে যুব সম্পৃক্ততা, আন্তঃদেশীয় নদী ও পানি
রাজনীতি, উদ্ভাবন, পানি, বাস্তুতন্ত্র
আলোচনা হয়। ওই সম্মেলনে পানি ও নদী
সম্পর্কিত সমস্যার ক্ষেত্রে যুব সম্প্রদায়কে সচেতন এবং একত্রিত করার বিষয়ে
গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ছাড়া সম্মেলনে প্রায় ৭শ সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পানি
ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের পরিকল্পনা উপস্থাপন করে। জাতিসংঘ আয়োজিত প্রথম পানি সম্মেলনে
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান পানি সংকট সমাধানে রাজনৈতিক উদ্যোগের আশা প্রকাশ করেছেন
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বিশ্বে বাড়তে থাকা পানির সমস্যা সমাধানে
রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণের কথা
জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সদস্য দেশগুলোকে
ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশে
বর্তমানে নদনদীর সংখ্যা প্রায় ৭শ। উপনদী-শাখানদীসহ নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২২,১৫৫ কিলোমিটার। নদীমাতৃক বাংলাদেশের জীবন-জীবিকার
অনেকটাই নির্ভর করে নদী বা পানির ওপর। আর এই নদী বেঁচে থাকা এবং পানির পর্যাপ্ত
সরবরাহ নির্ভর করে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল
এবং চীনের সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের ওপর। সামগ্রিক বিবেচনায় বিশ্ব পানি সম্মেলন
বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পানির চাহিদা ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি
পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে। বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য পানি নিয়ে
সৃষ্ট যাবতীয় সমস্যার সমাধান জরুরি। পানি সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য
বিশ্বের সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা
প্রয়োজন। এ ব্যাপারে উদাসীন থাকার
কোনো অবকাশ নেই।
টেকসই
উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) ৬ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে
প্রতিটি মানুষের নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা
হয়েছে। আর এটি বাস্তবায়নে পৃথিবী সঠিক পথে নেই। নিরাপদ পানির অভাবে পৃথিবীতে অগণিত স্কুল, ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা
কেন্দ্র, খামার এবং কারখানা তাদের
কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। তাই পানির সমস্যা সমাধান করে টেকসই
উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য সময়োপযোগী এবং ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সময়মতো এসডিজি গোল ৬-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য রাষ্ট্রগুলোকে গড়ে চারগুণ
দ্রুত কাজ করতে হবে। সমস্যাটি এমন নয় যে, কোনো
একক ব্যক্তি, রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান এর
সমাধান করতে পারবে। এটি সমাধানের জন্য প্রয়োজন
সফল রাষ্ট্রের সহযোগিতাপূর্ণ এবং সমন্বিত উদ্যোগ। পৃথিবীতে পানি সমস্যা কোনো একক
ব্যক্তি বা রাষ্ট্রকে নয়, সবাইকেই প্রভাবিত করবে। তাই এই সংকট সমাধানে সবাইকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথম
পানি সম্মেলন নিঃসন্দেহে পানির ব্যবহার এবং নিরাপদ পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতির
জন্য একটি বিশেষ মাইলফলক। পানি সংকট সমাধানে বিশ্বকে একত্রিত করার জন্য ওই সম্মেলন
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। শুধু
রাষ্ট্রপ্রধানরা নয়, সমাজের সব স্তরের মানুষেরই পানি সম্পর্কিত লক্ষ্য এবং এর
অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সহযোগিতা করতে হবে। প্রথম পানি সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি
কতটা তা এখনো পরিষ্কার নয়। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। তার পরও কৃষি মৌসুমে সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব থাকে। পানিবণ্টন
নিয়ে আমাদের নানা দুশ্চিন্তা রয়ে গেছে এখনও। সে জন্য দেশের মানুষের খাদ্য
নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নদীগুলোকে সুরক্ষা এবং পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা
প্রয়োজন। বাংলাদেশের পানি সংকট এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই নীতিনির্ধারকদের ভাবতে
হবে এবং এর ন্যায্য পাওনা আদায়ে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে
ভবিষ্যৎ পানি সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। সংবাদমাধ্যম এ ব্যাপারে বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত
প্রতিদিনের বাংলাদেশ শুরু থেকেই নানা আয়োজন করছে। পত্রিকাটির সপ্তাহজুড়ে ফিচার
পাতার নামকরণও হয়েছে নদ-নদীর নামে। এর মধ্য দিয়ে তাদের অঙ্গীকার স্পষ্ট। দায়িত্বশীল
প্রত্যেককে এ বিষয়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে।