অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
২৮ মার্চ প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব
আদেশ (আরপিও) সংশোধন প্রস্তাব গৃহীত হলে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা পাবে ইসি। ফলাফলের
গেজেট প্রজ্ঞাপন দেওয়ার পরও নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা রাখতে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে
সম্মত হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গেজেট প্রজ্ঞাপনের পরও
কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ওই নির্বাচন বাতিল করার
ক্ষমতা রাখবে। নির্বাচন কমিশনের তরফে বলা হয়েছে, এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে মতামত,
আলোচনা, তদন্তের ভিত্তিতে নির্বাচন বাতিল করতে পারবে তারা। আপাতত এ আইন নিয়ে মন্তব্য
করার আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি বলে মনে করি। কেমন অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন
বাতিল করা হবে? কারা অভিযোগ করতে পারবেন? অভিযোগের সময়টাও জানা প্রয়োজন। নির্বাচন নিয়ে
অভিযোগের গুরুত্বের পর্যায় সম্পর্কেও আমাদের স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি। বিষয়টি আরও খোলাসা
করা যাক। ধরা যাক নির্বাচন আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর কেউ অভিযোগ করলেন নির্বাচন সুষ্ঠু
হয়নি। এখন অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করে নির্বাচন বাতিল করা সম্ভব হবে না। কিন্তু এ
তদন্তকার্য কীভাবে পরিচালিত হবে তা স্পষ্টভাবে জানতে হবে। তবে একথাও মনে রাখতে হবে,
আমাদের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংবিধানের বিধি অনুযায়ী কম নয়।
আমরা অতীতে দেখেছি,
দ্রুত গেজেট প্রকাশ হওয়ায় তাৎক্ষণিক অভিযোগ করার সুযোগ পাওয়া যেত না। অভিযোগ থাকলেও
সেজন্য আদালতে মামলা করতে হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলার কোনো সুরাহা হতো না। কিন্তু
নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর ফলে এখন আর কিছু হবে না বলেই প্রত্যাশা করি যদি বিষয়টি
আইনে পরিণত হয়। তবে আমাদের আরও কিছু বিষয় জানার আছে। যেমন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার
কত দিন পর অভিযোগ নেওয়া হবে? অথবা কত দিনের মধ্যে অভিযোগ করলে তা খতিয়ে দেখা হবে এ
কথাও আমরা জানতে চাই। এমন তো হতেই পারে নির্বাচন আয়োজনের এক বছর পর কেউ অভিযোগ করলেন।
কিন্তু ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখে তার সত্যতা মিললেও নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করা যুক্তিসংগত
কিছু হবে কি না এও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। প্রচলিত সব আইনেই তাই সময় বেঁধে দেওয়া থাকে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিযোগ এলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর
ওই প্রতিবেদনে আরেকটি তথ্য নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার। নির্বাচন চলাকালে সাংবাদিক
ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কেউ বাধা দিলে কিংবা হামলা করলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে আইনি
ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতকরণে এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য।
তবে নির্বাচনে উপস্থিত থাকার জন্য অনুমোদিত সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা
যেন নিশ্চিত হয় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। নির্বাচন পর্যবেক্ষক কিংবা সাংবাদিকদের
প্রথমে নির্বাচন কমিশন থেকে একটি কার্ড সংগ্রহ করতে হয়। ওই কার্ড থাকলে তারা নির্বাচন
কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে পারেন। কিন্তু কার্ড সরবরাহ করা হয় নির্দিষ্ট দিনের ভিত্তিতে।
নির্বাচনের আগের দিন, নির্বাচনের দিন এবং আয়োজনের পরের দিন। সচরাচর এই তিন দিনের কার্ড
সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সংগ্রহ করতে হয়। একজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে
আমি অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানতে চাইব, নির্বাচনের কত দিন আগে কার্ড সরবরাহ করা হবে?
দেখা গেল, কোনো সাংবাদিক বা নির্বাচন পর্যবেক্ষক নির্বাচনের দুই দিন আগে কেন্দ্র পর্যবেক্ষণে
গেলেন। তখন কার্ড না দেখাতে পারলে তাকে বাধা দেওয়া হবে এবং এটাই স্বাভাবিক। সুষ্ঠু
নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতকরণে এ বিষয়টিও স্পষ্ট হওয়া জরুরি। যে শাস্তির ব্যবস্থা করা
হয়েছে তা কত দিন আগে থেকে প্রযোজ্য হবে তা-ও জানতে হবে। এমনকি বাধার মাত্রা কেমন হলে
এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে স্পষ্ট করতে হবে তা-ও। তবে নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতার বিষয়টি
এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায়। নির্বাচন কমিশনের তরফে বলা হয়েছে, তারা এখনও নানা পরিকল্পনা
করছে। এ প্রস্তাবে তারা ভবিষ্যতে সংযোজন-বিয়োজন করবেন। আমি মনে করি, উল্লিখিত বিষয়গুলো
যদি তারা বিবেচনায় রেখে থাকেন তাহলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু কিংবা প্রশ্নমুক্ত
হওয়ার কথা। জানা গেছে, প্রতিটি কেন্দ্রেই একজন রিটার্নিং অফিসার থাকবেন। এমনটা করা
হলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন করা সহজ হবে। আপাতত সব আইনই ভালো কিন্তু এ আইনগুলো কীভাবে
প্রয়োগ হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা চাই।
সংগত কারণেই নির্বাচনের
আগে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আমরা এবারও তা-ই দেখছি। এই সরকারের অধীনে নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের আপত্তি, সংলাপের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে এমনÑ বক্তব্যও
শোনা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারকেই
উদ্যোগ নিতে হবে সবার আগে। এখানে সরকারের ভূমিকার চেয়ে নির্বাচন কমিশনের তৎপরতাকে বেশি
গুরুত্ব দিতে হবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন
পর্যবেক্ষক হিসেবে দেশে-বিদেশে বহুবার আমন্ত্রণ পেয়েছি। অধিকাংশ দেশেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের
রুটিন আমাদের দেওয়া হতো। তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা
থাকত এবং একই সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গেও বৈঠকের আলাদা সময়সূচি নির্ধারণ করা হতো।
প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের জন্য বিষয়গুলো সহায়ক এবং বিষয়গুলো আমলে রাখা দরকার। নির্বাচনের
ক্ষেত্রে মূল শক্তি নির্বাচন কমিশন হলেও স্বচ্ছ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতকরণে সরকারের
ভূমিকাও এড়িয়ে যাওয়ার নয়। নির্বাচনী পরিবেশ স্বচ্ছ করতে পারলে দেশে-বিদেশে সরকারের
ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। এনট্রেলের এক নির্বাচনে গিয়েছিলাম। সেবার বুঝেছি, স্বচ্ছ পরিবেশ
নিশ্চিত করাই সদিচ্ছার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ। সরকারকে স্বচ্ছতার বিষয়ে স্পষ্ট চিত্র
তুলে ধরার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে।
সচেতনরা একটি
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে কি শুধু রাজনৈতিক
দলের অংশগ্রহণই বোঝায়? রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ভোটারদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না, ভোটাররাই মূল শক্তি। রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের রায়ের মধ্য দিয়েই
সরকার গঠনের বৈধতা অর্জন করে। যারা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন না এমন
ভোটারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাদেরও কীভাবে কেন্দ্রে আনা যায়, এ বিষয়ে ভাবতে হবে।
ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ালেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়। বিশেষত নারীদের এ বিষয়ে
আরও সচেতন করে তুলতে হবে। কোন দলকে ভোট দিতে হবে বা কেন্দ্রে কেন যাবে, এসব বিষয়ে অনেক
নারীরই ধারণা যথেষ্ট কম। সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতকরণে ভোটারদেরও সচেতনতা বাড়াতে
হবে। ‘ভোটার এডুকেশন’-এ উন্নত রাষ্ট্র সব সময় জোর দিয়ে থাকে বলেই তাদের নির্বাচনী পরিবেশ
এত গোছানো হয়। সব সময় বলেছি, যেকোনো নির্বাচন অবাধ-স্বচ্ছ-অংশগ্রহণমূলক করতে হলে ভোটার
এডুকেশনে জোর দিতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খুব বেশি সময় বাকি নেই। তার পরও
নির্বাচন কমিশন চাইলে ভোটার এডুকেশনের উদ্যোগ নিতে পারে। যদি ভোটারদের সচেতন করা যায়
তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা বহুলাংশে সহজ হবে। ভোটাররা সচেতন
হলে আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে। একজন ভোটার যখন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোট দেবেন
তখন রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনে অংশ না নিয়ে পারবে না। তখন ভোটাররাই প্রার্থীদের আশ্বস্ত
করবেন, আপনারা আসুন আমরা দেখেশুনে সবাইকে ভোট দেব। সচেতনতামূলক এ উদ্যোগ নির্বাচন কমিশনকেই
নিতে হবে।
নির্বাচনী পরিবেশ উন্নতকরণে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারাই এ ভূমিকা পালন করবেন তাদের প্রতি আমার প্রস্তাব, আপনারা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী পরিবেশ যাচাই করুন। দেশের গণমাধ্যমের অধিকাংশই দলভিত্তিক বলে যে অভিযোগ আছে তা দূর করার দায়িত্ব অনুধাবন করে কাজ করুন। যেকোনো প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মানসিকতা রাখলে নির্বাচনী পরিবেশে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য একটি আইনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে যে বিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি। সবকিছু সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা দুরূহ কিছু নয়। দরকার সংশ্লিষ্ট সবার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। জবাবদিহি যত বেশি নিশ্চিত হবে স্বচ্ছতার ছায়াও ততই বিস্তৃত হবে।