× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শ্রদ্ধাঞ্জলী

সত্তরের কালজয়ী তুখোড় ছাত্রনেতা

ডা. মুশতাক হোসেন

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩ ০৪:৪৫ এএম

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩ ১৭:৫৯ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

সিদ্দিকী ভাইকে যখন প্রথম দেখি তখনও আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হইনি। তবে দিনটা আমার ভালোমতোই মনে আছে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন কারওয়ানবাজারে গিয়েছিলাম। মনু মিয়া নামে এক শ্রমিকের লাশ কোলে খালি গায়ে একজন মিছিল করছে। তার সঙ্গে অন্যান্য শ্রমিকও যুক্ত হয়েছেন। পরে জানতে পারলাম ইনিই ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী। সেবারই প্রথম ‍নূরে আলম সিদ্দিকীকে সচক্ষে দেখেছি। তারপর বহুদিন তাকে জেলে থাকতে হয়েছিল। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়েও তিনি আন্দোলনরত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। তাই সত্তরের আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথ অনেকটাই বন্ধ ছিল। প্রতিবারই আন্দোলন সংগ্রামের জন্যই তাকে জেল খাটতে হয়েছে। তিনি ছয় দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০-১৯৭২ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন নূরে আলম সিদ্দিকী। অনলবর্ষী বক্তা তিনি। সত্তর সালে তার বক্তৃতায় আমরা চমৎকৃত হতাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যেতাম তার বক্তব্য। সত্তরের আন্দোলনে তার বক্তব্য ও নেতৃত্ব আমাদের সক্রিয়ভাবে আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। ওই সময়টাও ভীষণ উপভোগ করেছি আমরা। এজন্য সত্তরের এই তুখোড় ছাত্রনেতার মৃত্যুতে ভীষণভাবে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতরে জমে থাকা স্মৃতিরা ভীড় করতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের ‘চার খলিফার একজন’ হিসেবে নূরে আলম সিদ্দিকীকে উল্লেখ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তিনি যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যশোর-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। ক্ষিপ্রবুদ্ধির মানুষ হিসেবে তার সুনাম ছিল। উপস্থিত বুদ্ধি এবং নেতৃত্বদানের সাবলীল দক্ষতা থাকায় বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যও পেয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেল জীবনে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন।

নূরে আলম সিদ্দিকীর ক্ষিপ্রবুদ্ধির অনেক ঘটনা তার নিজের মুখেই শোনা। এসব ঘটনার অনেকগুলোই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বহুল প্রচলিত একটি ঘটনার কথা তার বয়ানেই উল্লেখ করিÑ “পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক তখন শাহেবজাদা ইয়াকুব আলী ও রাও ফরমান আলী। আমাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইলেকশন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডিনেন্স সম্পর্কে কোনো সংঘাত হলে সরাসরি মামলা দায়ের না করে আমাদেরকে গোয়েন্দা অধিদপ্তরে ডেকে সতর্ক করা হতো। আমি মাওলানা মওদুদীকে আবুল আ’লা ইহুদি বলে সম্বোধন করতাম। এটা নির্বাচনী আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। তারই সম্পর্কে সতর্কতা প্রদানের জন্য এখনকার প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় তখনকার তাদের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে সতর্ক করলেন। কথোপকথনের সময় টেবিলে রাখা ওনাদের অপূর্ব সুন্দর ইলেক্ট্রনিক সিগারেট লাইটার আমি হাতে নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছিলাম। শাহেবজাদা ইয়াকুব অত্যন্ত কৌতূহলী মনে আমাকে বললেন, মি. সিদ্দিকী, ‘ডু ইউ লাইক ইট, ইউ মে টেক ইট।’ কথাটি শুনেই আমি তাৎক্ষণিক লাইটারটি তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘থ্যাংক ইউ জেনারেল, উই আর অলরেডি বার্নিং, ডোন্ট অফার আস ফায়ার।’ ওনারা বিস্মিত এবং আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। কিছুটা বিমুগ্ধ ও বিহ্বলও হয়েছিলেন বটে। সঙ্গে সঙ্গে মুজিব ভাইকে ফোন করে উনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘ইস্ট পাকিস্তান তো আজাদ হো গ্যায়া। কোই রোক নাহি সাকতা।’ ওদিক থেকে মুজিব ভাই বলছিলেন, (নেতার সঙ্গে দেখা হলে তিনি নিজে বলেছেন) ‘ভাইসাব, হাম ইনসাফ মাংতা।’ এদিক থেকে জেনারেল ইয়াকুবকে বলতে শুনলাম, আমার বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে তিনি বলছেন, একজন ছাত্রনেতার উপস্থিত বুদ্ধি ও বুদ্ধিমত্তা এতো প্রখর হলে সেই জাতিকে অবদমিত রাখা যায় না। ওখান থেকে বেরিয়ে আমি ৩২ নম্বরে গিয়ে দেখলাম নেতা ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত। আমি কিছু বোঝার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ব্রাভো, ব্রাভো, আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ’।”

ইয়াহিয়া সামরিক আইন জারি করার পর সিদ্দিকী ভাই ছাত্রলীগের সভাপতি হন। সত্তরের নির্বাচন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে আমি নূরে আলম সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে আসি। ১৯৭০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ বই বাতিলের জন্য আমরা স্কুলের ছাত্ররা আন্দোলন করি। আমরা তখন ডাকসুর অধীনে আন্দোলনে নেমেছিলাম। তখন থেকেই সিদ্দিকী ভাইয়ের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই। তিনিও আমাকে ভালোভাবেই চিনতেন এবং স্নেহ করতেন।

সিদ্দিকী ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। যতদূর মনে পড়ে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে তার সঙ্গে ফোনে আলাপ হয়। ওটাই আমাদের শেষ আলাপ। আমি অবশ্য প্রয়োজনেই যোগাযোগ করেছিলাম। নূরে আলম সিদ্দিকী অনেক দিন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তার পক্ষে সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব না বলে জানিয়েছিলেন। তাই আমি তাকে ফোন করে অনুরোধ করি। তিনি আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। বিবিসির কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারটিই সম্ভবত তার শেষ সাক্ষাৎকার। এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে গেলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। জীবনের শেষ মুহূর্তে নানা কারণে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন বটে, কিন্তু আজও তিনি কালজয়ী। আমাদের স্মৃতিতে তিনি সত্তরের তুখোড় ছাত্রনেতা।


  •  সাবেক সাধারন সম্পাদক, ডাকসু

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা