× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মূল্যস্ফীতি ও অপুষ্টির ছায়া

ড. নাজমা শাহীন

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৩ ০৪:৩৭ এএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দামের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জনজীবনে। ৩ মার্চ 'গরিবের পুষ্টিতে টান' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয়ের তুলনায় ব্যয় এতটাই বেড়ে গেছে যে, ব্যয় সংকোচন করেও দৈনিক সুষম খাদ্যের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না নিম্নআয়ের মানুষের। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ পরবর্তী আরও দুটো খবর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি এত নিম্নমানের খাবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল বা ক্যান্টিনে যে খাবার খায়, তা তাদের দৈনিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারে না। মেধা বিকাশে যেসব খাদ্য উপাদান ভূমিকা রাখে, সেগুলো পূরণ না হওয়ার পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্নার ফলে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে। এ চিত্র যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তা কিন্তু নয়। দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বা ক্যান্টিনে এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। যেমন- ১১ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, ক্যান্টিন এবং খাবারের দামের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে 'পুষ্টির দশ আনাই বাকি' শিরোনামে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রায় একই চিত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের খাবারের পুষ্টিমান নিয়ে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনের পর সঙ্গত কারণেই আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু একটি সাধারণ বিষয় হয়তো সবারই চোখ এড়িয়ে যায়। এ জন্যই প্রথমে 'গরিবের পুষ্টিতে টান' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির কথা তুলে আনা। বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দাম যেখানে জনজীবনে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেখানে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রভাব ফেলাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুষম খাদ্য পাচ্ছে না- এ কথা সত্য। কিন্তু সে জন্য বিদ্যমান পরিস্থিতি বোঝা প্রয়োজন। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল কিংবা ক্যান্টিন চালু আছে। হল কিংবা ক্যান্টিনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভর্তুকি আছে। কিন্তু বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এতটাই বেশি যে, ব্যয় সংকোচন না করে খাবারে সংকোচন করতে হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে একটি হল পর্যবেক্ষণের দায়িত্বপালন করছি বহু বছর। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির নেতিবাচক প্রভাব আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রেও পড়তে শুরু করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে হল বা ক্যান্টিন পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ তদারকির কাজ করতে পারে। রান্না করার ক্ষেত্রে ক্যান্টিন পরিচালকরা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করছেন কি না, তা কঠোর নজরদারিতে রাখার কাজটি করেন হলের দায়িত্বশীল শিক্ষক কিংবা কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকা হোটেল- রেস্তোরাঁর তদারকির কাজটি অনেক সময় চাইলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করতে পারে না। দেশের প্রায় প্রত্যেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই হল ডাইনিং ব্যবস্থার পাশাপাশি ক্যান্টিনের ব্যবস্থা আছে। ডাইনিংয়ে নামমাত্র মূল্যে শিক্ষার্থীরা খাবার খেতে পারে। কিন্তু ডাইনিংয়ের একটা ধরাবাধা সময় আছে। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজ খরচ মেটানোর জন্য টিউশন কিংবা অন্য পার্টটাইম চাকরি খুঁজে নিতে হয়। তাই দিনশেষে তারা হল ক্যান্টিনেই খাওয়া-দাওয়া সম্পন্ন করেন।

সম্প্রতি খাদ্যপণ্যের উচ্চ দামের কারণে শিক্ষার্থীরা কম খাচ্ছে। তার পরও কুলাতে পারছে না। মেয়েদের হলগুলোতে মেয়েরা নিজেরাই রান্নার ব্যবস্থা করে। সেখানে তারা পরিপাটিভাবে রান্না করলেও তা যে দৈনিক পুষ্টির চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট— এমনটি বলা যাবে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্গতি নেই কিংবা পারিবারিক সহযোগিতা কম পায়- এমন শিক্ষার্থীরা মাসে ৪-৫ হাজার টাকা দিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটানোর চেষ্টা করে। বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে তুলনা করলে বাস্তবতা স্পষ্ট হয়। আমরা জানি, করোনা মহামারি শিক্ষাঙ্গনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। দীর্ঘদিন শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থী ভর্তির অনুপাতে তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের সঙ্গে সংযুক্ত আছি। অভিজ্ঞতা থেকে কিছু সমস্যা ও সম্ভাবনার জায়গা বলতে পারি।

করোনা দুর্যোগের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও আমাদের দায়বদ্ধতার পথ রুদ্ধ করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহযোগিতা করার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি আর্থিক সঙ্গতি নেই- এমন শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। করোনা দুর্যোগের সময় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ার পর ভর্তি প্রক্রিয়াও শুরু হয়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছিল এবং অন্যদিকে পুরোনো শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হবে কবে তা নিয়ে শঙ্কিত ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনেক বেড়েছে। এত শিক্ষার্থীর জন্য নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য যে পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পায় না। সে জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্ব দেয় কোনো হোটেল মালিককে। আবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় খাবারের দোকানগুলোর ওপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নজরদারি রাখে। সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষেরই আয়ের তুলনায় আর্থিক ব্যয় যেখানে বেড়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের অবস্থা কতটা নাজুক তা সহজেই অনুমান করা যায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ক্যান্টিন বা হল ডাইনিংগুলোতে তদারকির ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতির সুযোগ কম। বিশেষত শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ করে থাকে এবং প্রশাসন সব সময় হল বা ক্যান্টিন পরিচালকদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় হল বা ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষকে খাবারের দাম বেঁধে দিতে পারে, তবে তাও বাজারদরের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হয়।

ডাইনিং ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে খাবার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় বাসনপত্রের ব্যবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয় করে। পুরো প্রক্রিয়াটা শুধু একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। এত শিক্ষার্থীর খাবার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনের সুযোগ নেই বলেই খাবারে সংকোচন করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হল কর্তৃপক্ষ পণ্য কেনার দায়িত্ব নেয়। সে জন্য স্থানীয় বাজারে কম মূল্যে ভালো পণ্য পাওয়া যেতে পারে- এমন জায়গা খুঁজে নিতে হয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক সময় খাবারের মান বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খাবারের দাম কিছুটা বাড়িয়ে গুণগত মান বাড়ানোর প্রস্তাবনা থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এমন প্রস্তাব মানতে রাজি হয় না। এর স্বাভাবিক কারণ হল বা ক্যান্টিনের খাবারের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষার্থীদের অনেকেই খরচ কমাতে বিকল্প উপায় খোঁজে। শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পথ সুগম করার জন্য সরকারকে সচেতন হতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। না হলে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয় করে খাবার পরিবেশন করা কঠিন। যেমন- একটি মুরগি সচরাচর চারটি অংশে ভাগ করাটাই যুক্তিসঙ্গত। তবে হোটেল রেস্তোরাঁয় আট ভাগ করা হয়। মূল্যবৃদ্ধির ফলে তারা আট ভাগের বদলে ষোলো ভাগ করছেন। এভাবে খাদ্য সংকোচনের ফল ভালো হওয়ার কথা নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতি মেধা বিকাশের পথে একটি বাধা অবশ্যই; কিন্তু বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি পুরো দেশের জন্যই সমস্যা। বাজারের অস্থিতিশীলতা রোধকল্পে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও কিছু ভূমিকা নিতে হবে। ক্যান্টিনগুলোয় রান্নার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। খরচ কমানোর জন্য ক্যান্টিন পরিচালকরা নানা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। তারা অনেক সময় একটি তরকারি রান্না করে, সেই তরকারির ঝোলেই মাছ, মাংস বা সবজি রান্নার ব্যবস্থা করেন। এভাবে তারা অনেক খরচ কমান; কিন্তু এটি রান্নার স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি হতে পারে না।

খরচ কমানোর জন্য বা ব্যয়সঙ্গতির জন্য খোলা তেলের ব্যবহার কিংবা অস্বাস্থ্যকর মসলার ব্যবহার করা হয়। আবার আগের দিনে বেঁচে যাওয়া খাবার গরম করে ওইদিনের রান্নার সঙ্গে মিশিয়ে দেন- এমন অভিযোগ শোনা যায়। এগুলো সহজেই শনাক্ত করা যায়। হল ক্যান্টিন পরিদর্শনের জন্য দায়িত্বশীলদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের সুষম খাদ্যের জোগানের বিষয়টির সঙ্গে বাজারদরের উত্থান-পতন জড়িয়ে আছে। সে জন্য এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টির পাশাপাশি বাজার কঠোর নজরদারির কথাও ভাবতে হবে। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের আর্থিক সঙ্গতি বাড়ানোর জন্যে দূরদর্শী পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। যদি শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা বাড়ে, তাহলে তারাও সুষম খাদ্যের জন্য খরচ জোগাতে পারবে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সুষম খাদ্য প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে যূথবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।


  • অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা