মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৩ ০৪:০১ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
শুভবোধসম্পন্ন সবাই গান পছন্দ করেন। রুচি বা পছন্দের ভিন্নতার পরও সব শ্রেণির মানুষই গান শুনতে ভালোবাসেন। গান সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ। সব রকম গান সবার ভালো না-ও লাগতে পারে। প্রত্যেকের ভালো লাগার রকমফের নিশ্চয় রয়েছে। উইলিয়াম শেকসপিয়ার বলেছিলেন, ‘যে গান পছন্দ করে না, সে মানুষও খুন করতে পারে।’ একটি জাতির সাংস্কৃতিক মান নির্ধারণে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অগ্রগামিতার বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামেও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের সাংস্কৃতিক মাধ্যমের তুলনায় গান সবচেয়ে জনপ্রিয়। আমাদের ভূখণ্ডে এ-যাবৎ সংঘটিত সব আন্দোলন-সংগ্রামকে কেন্দ্র করে অজস্র গান, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেও তা হয়েছে এবং সেসব গান জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। গান কেবল ব্যক্তিগত ভালো লাগা ভাবাবেগে সীমাবদ্ধ নয়। গানের বহুমাত্রিক আবেদন ও ভূমিকা রয়েছে। প্রত্যেক দেশেরই রয়েছে পৃথক পৃথক জাতীয় সংগীত, রণসংগীত, দেশাত্মবোধক দেশপ্রেমের গান। জাতীয় পর্যায়েও গানের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রামীণ প্রান্তিক জীবনের সঙ্গে মিশে আছে লোকসংগীত। অঞ্চলভেদে লোকসংগীতের নানা রকমফের রয়েছে।
আধ্যাত্মিক. মরমি, মুর্শিদি, বাউল, কীর্তন, ভজন, শরিয়তি, মারফতিসহ
অনেক ধরনের গান। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুল
প্রসাদ, ডিএল রায়, লালন, হাছন রাজা
প্রমুখের গানও আমাদের সংস্কৃতির ভান্ডার ঋদ্ধ করেছে। শহরের মধ্যবিত্তরা আধুনিক
গানের প্রতি অধিক অনুরক্ত। তাই আধুনিক গানের ব্যাপকতা সর্বাধিক। রেডিও, টিভি, চলচ্চিত্র সর্বত্রে আধুনিক গানের আধিক্য।
প্রচারমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত গান যে পছন্দের ক্ষেত্রে সর্বজনীন, সেটা কিন্তু নয়। পছন্দের গান শুনতে একসময়কার কলের বাজনা, পরবর্তী সময়ে চেঞ্জারে, টেপ রেকর্ডারে, সিডি
প্লেয়ারে এবং বর্তমানে অধিক জনপ্রিয় সহজলভ্য ইউটিউবে অনায়াসে শোনা যায়।
প্রচারযন্ত্রগুলোর পাঁচমিশালি অনুষ্ঠানের ফাঁকে গানের অনুষ্ঠানও হয়। প্রযুক্তির
উৎকর্ষে এখন মানুষ পছন্দের শিল্পীর গান ইউটিউবে সার্চ দিয়ে সহজেই শুনতে পারে, এমনকি দেখতেও পারে। মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট যুক্ত থাকায়
ইউটিউব ব্যবহারে আর কোনো বাধা নেই। প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট মোবাইলের
বিস্তার ঘটেছে। স্মরণযোগ্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বড় সহায়ক
শক্তি জুগিয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। অর্থাৎ সংস্কৃতির আলো সবসময়ই বড় ভূমিকা
রেখে আসছে।
একসময়ে চলচ্চিত্রই ছিল বিনোদনের সর্বাধিক জনপ্রিয় মাধ্যম।
চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গানগুলোই মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এখন তো চলচ্চিত্রশিল্পের
ক্রান্তিকাল। মানুষ প্রেক্ষাগৃহ একপ্রকার ত্যাগই করেছে। চলচ্চিত্রের দর্শক আকালের
প্রধান কারণই হচ্ছে চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক অতিমাত্রার মুনাফার লোভ-লিপ্সা। স্থূল রুচিহীন চলচ্চিত্রের কারণে দর্শক সিনেমা
হলবিমুখ হয়েছেÑ এ অভিযোগ নতুন নয়। অথচ একসময় বিনোদনে
চলচ্চিত্রনির্ভর ছিল সিংহভাগ মানুষ। সেসব জনপ্রিয় ছবির গান মানুষের মুখে মুখে
ফিরত। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত
আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের ছিল স্বর্ণযুগ। স্বাধীনতার পর ক্রমান্বয়ে স্বর্ণযুগের
অবসানে চলচ্চিত্রশিল্প ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেও সম্প্রতি কিছু প্রতিভাবান নির্মাতা
এসেছেন। আশার আলো ছড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক ছবি ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে এবং আশার কথা সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে
নতুন মাত্রা দেখা যাচ্ছে।
১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টের দেশভাগের পর থেকে ১৯৬৫ সালের
সেপ্টেম্বরের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দীর্ঘকাল আমাদের
এখানে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বই, সাময়িকী, পত্রিকা; বোম্বের হিন্দি এবং কলকাতার বাংলা ছবির বিশাল বাজার গড়ে
উঠেছিল। ওই যুদ্ধের সময় আইয়ুব খান ভারতীয় সব প্রকাশনা ও চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী
স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সেই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। কিন্তু
জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা গানকে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। রেডিও, রেকর্ডে, টেপ রেকর্ডারে শ্রোতাদের কিন্তু গান শোনা
থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কলকাতার বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী হেমন্ত, সতীনাথ, কিশোর কুমার, মান্না
দে, আরতি ভাট্টাচার্য্য, সলিল
চৌধুরী, জগন্ময় মিত্র, শ্যামল মিত্র, লতা
মঙ্গেশকর, মানবেন্দ্র, ভূপেন
হাজারিকা, চিন্ময়, দেবব্রত
বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, তালাত মাহমুদ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়সহ অনেক শিল্পীর বাংলা গান আমাদের এখানে
ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। মুম্বাই-দক্ষিণের চলচ্চিত্রের রিমেক নির্মাণের
পাশাপাশি হালের হিন্দি গানের বেগবান স্রোতে বাংলা গানের অস্তিত্বসংকটে দুর্ভাবনা
দেখা দেয়। সমৃদ্ধ বাংলা গানের স্বতন্ত্রও টিকে থাকেনি। বাংলা গানের চাহিদা-কদরও আর সেখানে নেই। হিন্দি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বাংলা গান
এখন হিন্দির একচ্ছত্র দখলদারত্বে। বাঙালির প্রদেশ পশ্চিম বাংলা হিন্দি সাংস্কৃতিক
আগ্রাসনের কবলে এখন নিমজ্জিত। একইভাবে সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও বিস্তার লাভ করেছে।
একটি জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে পরাধীন করার ক্ষেত্রে ভাষা-হরণ হচ্ছে সর্বোচ্চ উপায় বা কৌশল, যেটা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই চেষ্টা করা
হয়েছিল। ওই কাজটি অত্যন্ত সুকৌশলে প্রয়োগ করেছিল ভারতের শাসকশ্রেণি। ভাষাও
সংস্কৃতিরই অনুষঙ্গ। ভারত বহু জাতির
দেশ। প্রতিটি জাতির রয়েছে পৃথক ভাষা ও সংস্কৃতি। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই।
সর্বভারতীয় প্রচার ও প্রতিষ্ঠার টানে মাতৃভাষা পরিত্যাগের হিড়িক যেমন দেখা যায়; তেমনি দক্ষিণ ভারতের তামিল, অন্ধ্র, কর্ণাটক, কেরালা চার রাজ্যের মানুষের তীব্র
জাতীয়তাবোধে বিস্মিত হতে হয়। তামিল, কন্নর, মালয়ালম, তেলেগু ভাষার বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রের সরকারি
ভাষা হিন্দির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে তারা গ্রহণ করেছে হিন্দিবিদ্বেষে।
ভারতের পুঁজিপতিশ্রেণি তাদের বাণিজ্যের অভিপ্রায়ে অভিন্ন ভাষার বলয় গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে পরাধীন ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে যুক্ত করে হিন্দি ভাষার প্রচার ও প্রসারে অনেক কিছু করেছে। স্বাধীন ভারতে হিন্দি সরকারি ভাষার স্বীকৃতি লাভে তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হলেও, হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে বিজেপি সরকারের ঘোষণা ও তৎপরতার পেছনে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর আশীর্বাদ কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভাষা আন্দোলনই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সূতিকাগার। ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার পথরেখা নির্মাণ করে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশের অবকাশ নেই। আমরা দেখেছি, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। বাষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর আমাদের প্রতিটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ে সাংস্কৃতিক জাগরণ মুক্তির পথ প্রশস্ত করে। স্বাধীন দেশেও এমন নজির আছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকাও সমুজ্জ্বল।