× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

২৫ মার্চ

গণহত্যার স্বীকৃতি এখনও না পাওয়ার বড় দুটি কারণ

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩ ০০:৪২ এএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীঅপারেশন সার্চলাইটকোডনেমে এক সুপরিকল্পিত নৃশংস গণহত্যা পরিচালনা করে ওই ঘৃণ্য অপারেশনের অন্যতম মূলহোতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪ পদাতিক ডিভিশনের মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তিনি পরবর্তী সময়ে তারস্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রিবইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘উই এক্সপ্লয়টেড ইস্ট পাকিস্তান অ্যান্ড হোয়েন পিপল রোজ ডিমান্ডিং দেওয়ার রাইটস অব সেলফ ডিটার্মিনেশন দ্য পাকিস্তান মিলিটারি দ্যান এনপাওয়ার্স রিটালিয়েটেড উইথ জেনোসাইডএখানে জেনোসাইড শব্দটি খেয়াল করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা বাদে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাঙালিদের দমনের দায়িত্ব যে ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত ছিল, সেই ব্যক্তি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে স্পষ্টতই বলছেন, ‘২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বড় দলিল আর হতে পারে না তারপরও আরও কিছু দলিলের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে

পূর্ব পাকিস্তানের কাছে পরাজয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয় একাত্তরে যুদ্ধক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হয় তদন্তকার্য পরিচালনার জন্য রাও ফরমান আলী তদন্ত সাক্ষ্যে বলেন, ‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকুব মালিক জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশনা পেয়ে কুমিল্লার নম্বর ব্রিগেডে অভিযান চলে সেখানে সামরিক অফিসারসহ ১৯৫ জন নিরীহ মানুষকে স্রেফ জবাই করা হয়েছিল কুমিল্লার পার্শ্ববর্তী সালদা নদী এলাকায় প্রায় ৫০০ জন মানুষকে হত্যা করে কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসকাণ্ড পরিচালনা করেপশ্চিম পাকিস্তানের গণহত্যার পক্ষে রকম আরও প্রমাণ রয়েছে পাকিস্তানের তদানীন্তন চিফ অব স্টাফ ছিলেন মেজর জেনারেল গুল হাসান যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যখনই পরিদর্শনে আসতেন কিংবা কুশলাদি বিনিময়ে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, তুমি কজন বাঙালিকে হত্যা করেছ? এটি একাত্তরে সৈয়দপুরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রহমান তার জবানবন্দিতে বলেছেন ওই কমিশনের সাক্ষ্যগুলো আজ গুগলে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে একাত্তরে গণহত্যার পক্ষে আরেকটি প্রমাণ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থদ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান ওই বইয়ে নিয়াজী লিখেছেন, ‘টিক্কা খান আমাকে বলেছেন, আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই সেখানের মানুষ আমার প্রয়োজন নেই টিক্কা খানের এই নির্দেশানুসারে জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব হুকুম পালন করেন ছাড়াও জেনারেল রাও ফরমান আলী তার টেবিলে ডায়রিতে লিখেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ ভূমি বাঙালির রঙে রঞ্জিত করা হবে ছাড়া নিয়াজি তার বইয়ে এও উল্লেখ করেছেন, ‘২৫ মার্চ রাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় অবস্থান করছিলেন তিনি সামনাসামনি টিক্কা খানের নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন সারারাত ট্যাংক, কামান গোলাগুলির শব্দ ভেদ করে ঢাকার অসহায় মানুষের আর্তনাদ শোনা গেছেজেনারেল নিয়াজীর বইটি বাদেও মেজর সিদ্দিক সালিকেরউইটনেস টু সারেন্ডার ব্যাপক জনপ্রিয় একটি বই ওই বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠায় ২৫ মার্চ রাতে এই ভূখণ্ডে কী ঘটেছিল, তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তিনি লেখেন, ‘একাত্তর সালের ২৬ মার্চ সকালে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত নিজের কমান্ডপোস্ট থেকে বাইরে এসে টিক্কা খান বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিলেন, ঢাকা শহরে নেড়িকুকুর বাদে আর কেউ আছে বলে তো মনে হয় না

২৮ মার্চ তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তানের কনসাল জেনারেল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি প্রতিবেদন পাঠায় ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি একটি বাছাইকৃত গণহত্যা ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ খ্যাতিমান সাংবাদিক সাইমন ড্রিংস দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ২৫ মার্চ কালরাতে তিনি ঢাকায়ই গোপনে অবস্থান করছিলেন এবং প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তও গোপনে সংগ্রহ করে চলে গিয়েছিলেন তার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনায় পরিচালিত এই অভিযানে শুধু ঢাকায়ই অন্তত সাত হাজার মানুষ নিহত হয়েছে ২৬ মার্চের গণহত্যার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ ১৯৮১ সালে সংস্থাটির সর্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে, মানব ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যত গণহত্যা হয়েছে, তার মধ্যে অল্প সময়ে সংখ্যার দিক থেকে বেশি মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে এই ভূখণ্ডেনৃশংস গণহত্যার ১০ বছর পর এই ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ গবেষকদের পরিশ্রম যথেষ্ট গবেষণার ফলে জাতিসংঘ গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এর স্বীকৃতি দিয়েছে এরকম আরও অনেক রিপোর্ট রয়েছে, যেগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত এমনকি একেকটি তারিখও গুরুত্বপূর্ণ

স্বাধীনতার পর পেরিয়ে গেছে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের তরফে মানবতার বিরুদ্ধে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়নি এমনকি এই গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদের এমনকি সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে, কেন আমরা বিচার পাইনি আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া এমনকি আফ্রিকায় সংঘটিত গণহত্যা ২৫ মার্চের গণহত্যার ন্যায় বড় পরিসরের না হয়েও স্বীকৃতি পেয়েছে আমরা এখনও কেন স্বীকৃতি পেলাম নাÑ এই প্রশ্ন ওঠা উচিত স্বীকৃতি বিচার না পাওয়ার ক্ষেত্রে আমি দুটি কারণ দেখতে পাই তার মধ্যে প্রথম কারণটিই মুখ্য বলে আমার ধারণা একাত্তরে গণহত্যা পরিচালনার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে এই ভূখণ্ডেরই একাংশ সহযোগিতা করেছে তথাকথিত ধর্মরক্ষার নামে জামায়াতে ইসলাম মুসলীগ লীগ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল এই অপশক্তিগুলোই পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিল তাদের রাজনৈতিক আদর্শ চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল না এবং আজও নেই পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে অন্ধকারে নিপতিত হয় গোটা জাতি, সেই অন্ধকার অনেকটা দূর হলেও পুরোপুরি এখনও কাটেনি ধারণা করা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে বিরুদ্ধপক্ষের যে অপশক্তি পঁচাত্তরের পর সক্রিয় হয়ে ওঠে তারা আজও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় অংশজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে এই অপশক্তি চায় না গণহত্যার বিচার হোক বরং এই বিচারপ্রক্রিয়া যেন না হয় সেজন্য তারা এখনও তৎপর তাদের ছায়াশক্তিও আছে দেশেই

দেশের বড় রাজনৈতিক কোনো পক্ষ যখন ৩০ লাখ শহীদের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে, তখন আমাদের দাবি দুর্বল হয়ে পড়ে দল-মত-ধর্মভেদে মতপার্থক্য থাকতেই পারে; কিন্তু এই একটি বিষয়ে আমাদের মধ্যে অন্তত মতপার্থক্য থাকার কোনোই সুযোগ নেই রাষ্ট্রের ভেতরেই যদি জাতিগত এই বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে না ওঠে, তাহলে স্বীকৃতি দানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কিছুই করার থাকে না সংগত কারণেই জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এগিয়েও আসবে না আর এখানেই বিচার না পাওয়ার দ্বিতীয় কারণটি পর্যালোচনা করতে হয় ভুলে গেলে চলবে না, একাত্তরে বৈশ্বিক শক্তিবলয়ে থাকা পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার মেরুকরণ ঘটছিল একটি পক্ষ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল এবং অপর পক্ষ পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পরও ক্ষমতাবলয়ে অবস্থানের পরিবর্তন খুব একটা হয়নি যারা আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল তাদের জন্য গণহত্যার স্বীকৃতি ইতিবাচক নয় জাতিসংঘে গণহত্যার স্বীকৃতির প্রস্তাব উপস্থাপনের পর ভেটো শক্তি আছে এমন রাষ্ট্র বিরোধিতা করলে আমরা স্বীকৃতি পাব না আমি মনে করি, এই দুটি বড় কারণের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছি না এজন্য জরুরি জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা

বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের করণীয় কী? দেশের নাগরিক সমাজ সরকারের পৃথক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে সরকারকে জোরালো প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দল-মত-নির্বিশেষে প্রত্যেকেই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায় নিজেদের স্বার্থেই বিভেদের রাজনীতির অবসান জরুরি দেশের নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনকে এই বিভেদীকরণ থেকে মুক্ত করার পথ সৃষ্টি করা যেতে পারে বিশ্বের কোথাও স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ দুটি শক্তির অবস্থান নেই দেশের নাগরিকরা গণতান্ত্রিক ক্ষমতা ভোটাধিকার বলে বিরুদ্ধপক্ষ শক্তিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষে যে রাজনৈতিক দল নেই, তাদের কখনও ক্ষমতায় আনা যাবে নাÑ এমন একটি সিদ্ধান্ত জাতিগতভাবে আমাদের নিতে হবে তারপর একাত্তরের গণহত্যার জন্য বিচার চেয়ে নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে আবেদন করতে হবে সচরাচর ওখানকার বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হয় তা হোক তাও আমরা গণহত্যার বিচার যেন পাই বিলম্বে হলেও বিচারপ্রাপ্তির পথ যাতে বন্ধ না হয়Ñ এই চেষ্টাও সরকারকে চালাতে হবে আমাদের কাছে যত অকাট্য দলিল রয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, রায় আমাদের পক্ষে আসবে মামলার রায়ের জন্য ২০-২২ বছর অপেক্ষা করতে হলেও আমরা করব, কিন্তু প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব এটি আমাদের জাতিগত দায়িত্ব


  • বীর মুক্তিযোদ্ধা গবেষকনিরাপত্তা  রাজনৈতিক বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা