× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পাহাড়ের আড়ালকে বেছে নিতে তৎপর কেন অপশক্তি

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩ ১৩:২৬ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

শান্তিচুক্তি পাহাড়ে শান্তির ছায়া ফেলেছিল। কিন্তু পাহাড়ি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত এবং পাহাড়ে জঙ্গি তৎপরতা যেন শান্তির ছায়া ক্রমেই ফিকে করে তুলছে। এ আগুনে নতুন করে হাওয়া দিয়েছে ১৩ মার্চ পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ। তাদের হামলায় ওই দিন এক সেনা সদস্য নিহত হন। সশস্ত্র সংগঠনটির হামলায় আহত হন আরও দুজন সেনা সদস্য। এই ঘটনার প্রেক্ষপটে তো বটেই, শান্তিচুক্তির পরও, চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী পাহাড়ের শান্তি নষ্ট করতে তৎপর হয়ে উঠেছে, তারই সূত্র ধরে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবার একই প্রশ্ন উঠে আসছে- পাহাড়ে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়া আসলে কিসের আলামত? লক্ষণীয়, যারা শান্তিচুক্তির পক্ষে ছিলেন তারা পার্বত্যাঞ্চলের নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা এই মুহূর্তে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে তারা তো শান্তিচুক্তির পক্ষে নয়। পাহাড়ে শান্তি বিঘ্নিত করার লক্ষ্য নিয়েই তারা সেনা সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি পার্বত্যাঞ্চলের সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা চালাচ্ছে। অনেক সময় তাদের জিম্মি করছে। অস্ত্রের মুখের পাহাড়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে। শুধু এই সশস্ত্র গোষ্ঠীই নয়, সম্প্রতি পাহাড়ে জঙ্গিরা নানা কৌশলে সক্রিয় এবং তাদের তৎপরতারও খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতায় পাহাড় থেকে জঙ্গি আস্তানা যেমন ধ্বংসের খবর আসছে, জঙ্গিদের আটকের খবরও আসছে। পাহাড়ে জঙ্গি তৎপরতা কমাতে র‌্যাবসহ সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় জানিয়েছেন, পার্বত্য এলাকাকে জঙ্গিরা আর নিরাপদ মনে করছে না। কাজেই শান্তিচুক্তির সঙ্গে এই জঙ্গি বাহিনীর অস্ত্র সংবরণের বিষয়টি মিলিয়ে দেখা ঠিক হবে না। তবে আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে কেন পাহাড়ে সেনা সদস্যদের ওপর হামলা হচ্ছে?

এর আগেও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ দেশের জঙ্গিবাদের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করেছি। তখন বলেছিলাম, দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো জঙ্গি সংগঠন এখনও গড়ে ওঠেনি। স্থানীয় শক্তিশালী কোনো পক্ষের স্বার্থ হাসিলের জন্য এ সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হয়। ১৩ মার্চ সেনা সদস্যদের ওপর সংঘটিত হামলার কথাই ধরা যাক। হামলার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে এটুকু স্পষ্ট হয়, অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে হয়তো পাহাড়ের উগ্রপন্থিদের যোগাযোগ রয়েছে। অতীতেও আমরা দেখেছি পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনগুলো যোগাযোগ ও সমঝোতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। অনেক জঙ্গি সংগঠনই তাদের প্রশিক্ষণব্যবস্থা আয়োজন করার জন্য পার্বত্যাঞ্চল বেছে নিয়েছে। কারণ তারা পাহাড়ের আড়ালকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়াতে চেয়েছে। তবে দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো এখনও এতটাও শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি যে, তারা পার্বত্যাঞ্চলকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারবে। শান্তিচুক্তি বিঘ্নিত করাও তাদের পক্ষে কঠিন হবে। এক্ষেত্রে মনে করি, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের চলমান প্রক্রিয়া তার স্বাভাবিক গতিতেই অব্যাহত রাখা জরুরি। তবে পাহাড়ে হুটহাট গজিয়ে ওঠা অপশক্তিগুলোকে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

আশার কথা, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে যথেষ্ট সফলতা দেখাতে পেরেছে। এর প্রমাণ ১৪ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি। ওই প্রতিবেদনেই জানা গেছে, জঙ্গিরা ঘাঁটি হিসেবে পার্বত্যাঞ্চলকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। অর্থাৎ এরা খুব বেশি শক্তি বৃদ্ধি করতে পারেনি। এখন এ অপশক্তিকে যত দ্রুত পাহাড় থেকে উৎখাত করা যাবে তত দ্রুত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে। এক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে যারা প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর গড়তে তৎপর তাদের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই আসে না। যেহেতু তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে তাই তাদের উৎখাত করতে হবে। তাদের সঙ্গে যেসব জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা আছে সেগুলোকেও চিহ্নিত করে মূলোৎপাটন করতে হবে।

সম্প্রতি কিছু পাহাড়ি গোষ্ঠীর অপতৎপরতার সমান্তরালে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতাও বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে যদিও বলা হচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলো পার্বত্যাঞ্চলকে নিরাপদ মনে করছে না। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতা অনেক সময়ই এর উল্টো সাক্ষ্যও দিচ্ছে। কারণ এক সময় জঙ্গি সংগঠনগুলো সমতল অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, চর কিংবা বনভূমিঘন এলাকায় নিজেদের ঘাঁটি গড়ত। কিন্তু সমতল অঞ্চলের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় তারা এখন পার্বত্যাঞ্চলকেই বেশি নিরাপদ মনে করছে। পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে নিজেদের নিরাপদ আস্তানা খোঁজার চেষ্টা করছে। জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততায় এসে পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলোও প্রভাবিত হবে, এমনটা অস্বাভাবিক নয়। আর এই অপপ্রভাবের কারণেই পার্বত্যাঞ্চলে সম্প্রতি কয়েকটি বিচ্ছিন্ন হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সাম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আঁচ করতে পেরেছে। তাই তারাও নিয়মিত বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে এবং অভিযানে সফলতাও পাচ্ছে। একটি সফল অভিযান শেষে জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কিংবা তাদের সহযোগীদের আটক করার পর ওই জঙ্গি সংগঠন কিছুটা তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের নেতৃত্বাধীন অংশ তখন ভাবে, যদি পালটা আক্রমণ করা না যায় তাহলে সংগঠনের শক্তিমত্তা প্রদর্শিত হয় না। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফল অপারেশনের পর জঙ্গি হামলার সম্ভাবনাও বাড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের সতর্কতার মাত্রা আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো যেন শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কৌশল পাল্টে এগোতে হবে বলে মনে করি।

বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা থেকে অভ্যন্তরীণ বিষয়াদির সম্পর্ক অনেক বেশি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে আবর্তন করেই জঙ্গিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত কিংবা পরিবর্তনের জন্য স্বার্থান্বেষী কেউ কেউ জঙ্গি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আমরা দেখছি, দেশের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে এলে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবে এবার তাদের অতীতের তুলনায় কিছুটা কম সক্রিয় দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচনে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেক অসাধু চক্রই জঙ্গি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে যাতে নির্বাচনে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আবার অনেকে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার জন্যও জঙ্গিবাদকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে- এমন তিক্ত অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। ইতোমধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন জটিল হয়ে উঠছে তেমনি নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অনেকের ধারণা, এই অস্থিতিশীল পরিবেশের সুযোগ নিতে ওত পেতে আছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ রাজনীতিকরা যতটা নিতে পারেন জঙ্গিরা ততটা পারে না। বরং বলা যায় রাজনীতিকরা জঙ্গিদের মাধ্যমে সুযোগ নেন। রাজনৈতিক কারণে জঙ্গিদের ব্যবহার করা হয়। দেশে আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত জঙ্গি সংগঠনের থেকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত জঙ্গি সংগঠনই বেশি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই সংগঠনগুলোর ব্যবহার বাড়ে। নির্বাচনী পরিবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্বেগ বাড়ানোর পাশাপাশি অরাজক পরিবেশ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে জঙ্গি সংগঠনগুলো ব্যবহৃত হয়। এজন্য দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে যে রাজনৈতিক অপউদ্দেশ্য রয়েছে তা বলা অমূলক হবে না।

জঙ্গিবাদ দমনে সব সময় রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা বলা হয়। শুভবোধসম্পন্নরা মনে করেন, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে জঙ্গি সংগঠনকে আর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোও জঙ্গিবাদ দমনে দাবি তুলে নানা প্রতিশ্রুতি-প্রত্যয় ব্যক্ত করে। কিন্তু এখনও জঙ্গিবাদ দমনে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্য নেই, এ বিষয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। দেশে যারা জঙ্গি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদের কাছে রাজনৈতিক ঐকমত্য আশা করা দুরাশা বৈ কিছু নয়। এজন্য জঙ্গিবাদের শিকড় খোঁজা জরুরি। জঙ্গিবাদের উৎখাতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কৌশলগত অবস্থান নির্ণয়ও জরুরি। জঙ্গিবাদে যাদের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, তাদের শনাক্ত করার মধ্য দিয়েই এ অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা সম্ভব। বিদ্যমান বৈশ্বিক বা অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি, জঙ্গি তৎপরতার পারদ ওঠানামা করে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। বিশেষত জাতীয় নির্বাচনের আগে জঙ্গি দমন কৌশল তৈরি করা এবং নিয়মিত অভিযান বাড়াতে হবে। জঙ্গিবাদের ঝুঁকি সময় অনুসারে শনাক্ত করার মাধ্যমেই বিদ্যমান সংকটের নিরসন সম্ভব।


  • নিরাপত্তা বিশ্লেষক  ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট অ্যান্ড ডেভেলমেন্ট স্টাডিজ (আইসিএলডিএস)-এর নির্বাহী পরিচালক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা