সম্পাদকীয়
প্রবা
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩ ২১:১১ পিএম
স্বল্পায়ু কবি আবুল হাসান তার 'অগ্নি দহন বুনো দহন' কবিতায় লিখেছেন, 'বুনো আগুনের ছোঁয়া দহনেই করেছি মাতম শুধু,/ পাপের মোড়কে দু'হাত ঢুকিয়ে পাখিদের আর তরু/ বীথিদের সাথে চারিয়ে দিয়েছি নৃশংস ডম্বরু/মাটিতে মর্মে হায়রে এ কোন দহনের হলো শুরু...'। এই গৌরচন্দ্রিকার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্টিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। আবুল হাসানের এই কবিতার পক্তির সঙ্গে তিতাস গ্যাস কোম্পানিটির বিদ্যমান পরিস্থিতির অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। অনিয়ম-দুর্নীতির দহনে কিভাবে প্রতিষ্ঠানটি দক্ষ হচ্ছে, এরই চিত্র উঠে এসেছে গত তিন দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। তিতাসের অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওই প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা গেছে-এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, তিতাসের দুর্নীতিবাজদের এত শক্তির উৎস কোথায়। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার মগবাজার, সিদ্দিকবাজার, সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা অনুসন্ধানে উঠে আসে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির দায়িত্বহীনতার চিত্র। দেখা গেছে, তাদের সরবরাহ লাইনে ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিপদাশঙ্কা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। এতগুলো মর্মান্তিক ঘটনার পরও তিতাসের দায়িত্বশীলরা শুধু মিথ্যাচারই করেননি, খোঁড়া যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন। বাংলাদেশ তেল-গ্যাস ও খনিজে সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান তিতাসে কী নগ্নভাবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছেন এবং সেবাদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটির অব্যবস্থাপনার কারণে জীবনঝুঁকির পাশাপাশি রাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে স্ফীত হচ্ছে সমান্তরালে, তা-ই ফের জানা গেল। একেকটি ঘটনার পর তদন্ত প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ শুধু দায় এড়ানোর চেষ্টাই করেনি, একই সঙ্গে স্বেচ্ছাচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতেও চেষ্টা চালিয়েছে। এ পর্যন্ত তিতাসের অসাধুদের অনিয়ম- দুর্নীতির পাশাপাশি দায়িত্বহীনতার সুলুকসন্ধান করে বিভিন্ন সংস্থা ও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হলেও সেসব বাস্তবায়নের নজির যেমন বিরল, তেমনি দুর্নীতিবাজদের তি দৃষ্টান্তযোগ্য বিচার না হওয়ার বিষয়টিও ক্ষোভ-জাগানিয়া। তাদের প্রিপেইড মিটারে দুর্নীতির ফাঁদ কীভাবে পাতা রয়েছে, তাও উঠে এসেছে ওই অনুসন্ধানী ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। এমন নজিরও আছে, প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি-অনিয়মে সম্পৃক্ততার অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানালেও আজও এর কোনো অনুসন্ধানই হয়নি! অভিযোগের সমাধান খোঁজা হয় শুধু বদলি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে! তিতাসের দুর্নীতিবাজদের শিকড় কী এতই গভীরে প্রোথিত কিংবা তাদের কালোহাত কী এতটাই প্রসারিত যে, কোনো আইনই তাদের স্পর্শ করতে পারে না? তিতাসের পরতে পরতে যেভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে তা ভেঙে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, আমরা এ প্রশ্নও রাখি। আরও প্রশ্ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যেখানে 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র অঙ্গীকার রয়েছে, সেখানে তিতাসে দুর্নীতির মহোৎসব চলছে কী করে? তিতাস গ্যাসের সংযোগ থেকে শুরু করে বিল আদায়সহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়মের কারণে সেবা তো নয়ই, বরং দুঃখজনকভাবে গ্রাহকের ভোগান্তি সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। গ্যাস বর্ণহীন দাহ্য পদার্থ বটে, কিন্তু গন্ধহীন নয়। আমরা জানি, নির্বিষ গ্যাস যেমন আছে তেমনি আছে বিষাক্ত গ্যাসও। বিদ্যমান পরিস্থিতি সাক্ষ্য দেয়, তিতাসের দায়িত্বশীল অনেকেই দুর্নীতির বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজেদের ভোগের উপাত্ত করেছেন এবং তাদের কারণে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। আমাদের বোধগম্য নয়, তিতাসের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা পেট্রোবাংলা কেন এত অভিযোগের পরও যথাযথ প্রতিকার নিশ্চিত করতে পারছে না? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই বা কী করছে? মূল্যবান সম্পদের অপচয় হচ্ছে, ভোক্তারা তিতাসের দুর্নীতিবাজদের কারণে নানাভাবে বিড়ম্বনা পোহাচ্ছেন, দেশের ক্ষতি হচ্ছে আর এর বিপরীতে অসাধুদের পকেট ভারী হচ্ছে কী বিস্ময়কর প্রতিকারহীনতার চিত্র! ইতঃপূর্বে সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছিল তিতাসের চুনোপুঁটিও অনিয়মের পথে কীভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। এত সব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরও প্রতিকারহীনতার ছায়ায় কিভাবে আছে তিতাস? আমাদের স্মরণে আছে, ইতঃপূর্বে দুদকের ‘তিতাসের দুর্নীতির ২২ উৎস' শিরোনামে প্রতিবেদনটি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে দাখিল করার পর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ চলছে। প্রতিবেদনটি এ কাজে সহায়তা করবে'। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অঙ্গীকার কি পালিত হয়েছে? দোষীরা কি শাস্তি পেয়েছে? নাকি ‘দুর্জনের ছলনার অভাব হয় না'- এ প্রবাদকে যথার্থ প্রমাণ করে তিতাসের দুর্নীতিবাজরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে? এভাবে চলতে পারে না। আমরা অনতিবিলম্বে তিতাসে সৃষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষত উপশমে সরকারের কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই।