× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাঙালি পাকিস্তানপন্থিদের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩ ১৩:৪১ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

একাত্তরে জাতীয়তাবাদের পরস্পরবিরোধী দুটি রূপ পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছিলÑ একটি দখলদারিত্বের, অপরটি আত্মরক্ষার। একদিকে হানাদার পাঞ্জাবি, অন্যদিকে আক্রান্ত বাঙালি। কিন্তু বাঙালি সমাজেও একটি অংশ ছিলÑ যেটি এমনকি একাত্তর সালেও পাকিস্তানে বিশ্বাস করত। এই বিশ্বাসকে তারা আঁকড়ে ধরে রেখেছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো করে। স্বাধীন দেশেও তাদের অপতৎপরতা কম পরিলক্ষিত হয়নি এবং এখনও যে অপতৎপরতার চেষ্টা চালায় না তা তো নয়।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ মূলত ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদ। মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি, তাদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি চাইÑ এই বোধ ও দাবিই কাজ করেছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে। মুসলমানরা স্বতন্ত্র আবাসভূমি পেলে নিজেদের সংস্কৃতিকে বিকাশিত করতে পারবে এবং তাদের ইহজাগতিক উন্নতি সম্ভব হবেÑ এই আশাটাই ছিল চালিকা শক্তি। তাই বলে সারা পৃথিবীর মুসলমানরা যে এক জাতি, এটা বলা সম্ভব ছিল না। কেননা বাস্তবতা সেই রকমের ধারণাকে সমর্থন করে না। বাংলায় যে মুসলমানরা বাস করেন তাদের মাতৃভাষা বাংলা, কিন্তু তারা আগে মুসলমান পরে বাঙালি, এটাই ছিল পাকিস্তানবাদী চিন্তার মূলভিত্তি। এই চিন্তায় বিশ্বাসীরা কেউ কেউ আবার রাষ্ট্রকে ইসলামি চরিত্র দিতে চাইতেন, অন্যরা রাষ্ট্রের মুসলমান পরিচয় নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। মুসলমান পরিচয়ে সন্তুষ্টরাই মূলধারা; তারাই ছিলেন অধিক সংখ্যক। তারা ইহজাগতিক উন্নতিই চাইতেন। ওই উন্নতি অবশ্যই ছিল পুঁজিবাদী ধরনের।

বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানে নেই, কিন্তু তাদের অনেক অনুসারী এখানে রয়ে গেছে, যারা ধর্মীয় পরিচয়ে গর্বিত। তারা সমাজের ভেতরে কার্যকর এবং পুঁজিবাদী উন্নতিতেও আস্থাশীল। মুসলমান পরিচয়ে গর্বিত এবং পুঁজিবাদী উন্নতিতে আস্থাশীলরা সমাজের ভেতরে কার্যকর রয়েছেন। ইসলামি জঙ্গিবাদীরাও নানাভাবে সক্রিয়। তারা কখনও একটু চুপ মেরে থাকে, আবার সুযোগ পেলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এমন নজির আছে আমাদের সামনে অনেক। জঙ্গিবাদীরাও পুঁজিবাদীই, তাদের প্রধান শত্রু সমাজতন্ত্রীরা। প্রয়োজন দেখা দিলে যাদেরকে তারা নাস্তিক বলে ডাকে। তারা নিজেরা পরকালের জন্য অক্ষয় ব্যক্তিগত পুঁজি সঞ্চয়ের আশায় অনুপ্রাণিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সমষ্টিগত অগ্রগতির পথে পুঁজিবাদী উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা বেশ ভালো রকমের প্রতিবন্ধক তৈরি করে রেখেছে এবং রাখবেও।

একাত্তরে বাঙালি পাকিস্তানবাদীদের অবস্থান ও চিন্তার পরিচয় বিভিন্ন ধরনের লেখায় পাওয়া যাবে। বেশ পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাবে দুজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর রচনাতে। একজন হচ্ছেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (১৯২০-৯৫), অন্যজন জি ডব্লিউ চৌধুরী (১৯২৬-৯৭)। কর্মজীবনে এরা দুজনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাকিস্তানের শাসনামলে তারা উচ্চপদ পেয়েছেন, যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে কাজ করেছেন এবং ওই রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়ায় ভীষণ রকমের কষ্টে পড়েন। দুজনের মধ্যে পার্থক্যও ছিল, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ছিলেন আমলাতান্ত্রিকতার প্রতি আকৃষ্ট, আর জি ডব্লিউ চৌধুরী ছিলেন পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক। দুজনই দৃশ্যমানরূপে আধুনিক ছিলেন, তবে ড. হোসায়েনের ভেতর কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক পিছুটান ছিল, ড. চৌধুরীর ক্ষেত্রে যা চোখে পড়েনি। এদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে তিন তিনটি কারণে। প্রথমত একাত্তরের যুদ্ধের (এবং তার আগেরও) ইতিহাসের একটি বয়ান এখানে পাওয়া যাবে, যেটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ান থেকে ভিন্ন। দ্বিতীয়ত, তারা যা বিশ্বাস করেছেন, বলেছেন এবং যেভাবে পাকিস্তানকে রক্ষা করাটাকে কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেনÑ এর ভেতরে ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য উপাদান আছে। তৃতীয়ত, আর সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণÑ তারা যে রক্ষণশীল ও পুঁজিবাদী মনোভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করেন, সেটা তখন বেশ ভালোভাবেই কার্যকর ছিল এবং এখনও আছে এবং এর অনুকূল বাতাস বরং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই মনোভঙ্গির ধারকরা উদারনৈতিক হতে চান, কিন্তু সুবিধা করতে পারেন না। নিউইয়র্কে যান, আবার সৌদি আরবেও যান।

সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন কর্মজীবনে সবটা সময়জুড়েই তিনি শিক্ষক ছিলেন, প্রশাসনিক পদে গেছেন, তবে সেসব অবস্থান শিক্ষা বিষয়ের বাইরে ছিল না। তার লেখা কিছু বইপত্র ও প্রবন্ধ আছে, যেগুলোর ভেতর জরুরি অংশ হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজবিষয়ক রচনাগুলো। দুটি রচনা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়েছে, একটি ইংরেজিতে, অন্যটি বাংলায়। ইংরেজি বইটির নাম ‘দি ওয়েস্টেজ অব টাইম’ (১৯৯৫), বাংলা বইটি ‘একাত্তরের স্মৃতি’ (১৯৯৩)। প্রথম বইটি তিনি লিখেছেন কারাবন্দি অবস্থায়, ১৯৭২-৭৩ সালে। দ্বিতীয়টি অবসরকালে, ১৯৯৩ সালে। এ ছাড়া ডায়েরির আকারে লিখিত কিছু অমুদ্রিত নোটস আছে, যেগুলো তিনি অবসর সময়ে লিখেছেন, ১৯৮৯তে শুরু করে। আছে দ্য ইসলামিয়া কলেজ ইয়ার্স নামে একটি রচনা; দৈনিক বাংলাদেশ অবজার্ভার-এ প্রকাশিত কিছু ইংরেজি রচনা। এগুলো ১৯৮৬-১৯৯৪-এর মধ্যে সময়ে লেখা। মুদ্রিত বই দুটি আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে, পুস্তাকাকারে অপ্রকাশিত লেখাগুলোর ফটোকপি ড. হোসায়েনের একজন অনুরাগী আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। আত্মকাহিনীমূলক এই লেখাগুলোতে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে ড. হোসায়েনের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার এমন একটি অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়, যা আনুষ্ঠানিক রচনাতে পাওয়া যাওয়ার কথা নয়।

আমার পক্ষে ড. হোসায়েনের মতাদর্শ যেমন- তেমন, তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকার নৈর্ব্যক্তিক বিবেচনা করাটা বেদনাদায়ক। তিনি আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষক ছিলেন; পরে তার সহকর্মী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তার কাছে আমার ঋণ আছে বহুবিধ। তার কর্মধারা এবং আমার কর্মধারা যে পৃথক, কেবল পৃথক নয়Ñ অনেক জায়গায় যে পরস্পরবিরোধী ছিল; সেই সত্যেরও একটা উপযোগিতা অনস্বীকার্য। কর্তব্যনিষ্ঠা, বিদ্যানুশীলন, শিক্ষকতায় আগ্রহ, তার এসব গুণ ছিল রীতিমতো অনুকরণীয়। ড. হোসায়েনের সাহিত্যজ্ঞান ছিল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও প্রখর। অর্থোপার্জনের জন্য ছোটাছুটি করা তার কালেও স্বাভাবিক ব্যাপারই ছিল; কিন্তু তিনি সে পথ মাড়াননি। তার নিকটজন চাচাতো ভাই সৈয়দ আলী আহসানও অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক আলী আহসান সম্পর্কে সুবিধাবাদিতার যে ধরনের অভিযোগ আছেÑ অধ্যাপক হোসায়েনের ব্যাপারে তা অবান্তর। দি ওয়েস্টেস অব টাইম বইতে অধ্যাপক আলী আহসানের কথিত সুবিধাবাদিতার বিরুদ্ধে বিস্তর ধিক্কারধ্বনি রয়েছে।

মেরুদণ্ডহীনতা বাঙালি মধ্যবিত্তের সাধারণ ও অনেকটা সর্বজনীন ব্যাধি; সাজ্জাদ হোসায়েন সে ব্যাধি থেকে মুক্ত ছিলেন। তার ন্যায়-অন্যায় বোধ স্পষ্ট ছিল এবং তিনি যা ন্যায় মনে করতেন, বিপদের মুখে পড়লেও সেখান থেকে সরে আসতেন না। তবে সামষ্টিক স্বার্থের বিবেচনায় তার পথটি অবশ্যই ভ্রান্ত ছিল। সে পথে চলতে গিয়ে একাত্তরের যুদ্ধ শেষে তিনি ভয়ংকর সংকটে পড়েছিলেন। প্রাণে মারা যাননি, তবে দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, শরীরে অনিরামেয় ক্ষতি হয়েছে। দুই বছর তাকে ঢাকার জেলখানায় থাকতে হয়েছে, দশ বছর চাকরি করেছেন মক্কায় গিয়ে। শেষ দশ বছর ঢাকাতেই কাটিয়েছেন, তবে নিঃসঙ্গ অবস্থাতে। ওই দশ বছর তিনি আরবি সাহিত্যের ইতিহাস নামে একটি বই লিখেছেন, ইতঃপূর্বে লিখিত ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস বইটি পরিমার্জনা করেছেন, ইংরেজি দৈনিকে কলাম, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র ইত্যাদি লেখাতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এবং বই পড়েছেন। কিন্তু সময়ের যথার্থ ব্যবহার করতে পেরেছেন এমনটা বলা যাবে না। চূড়ান্ত বিচারে তার জীবনকাহিনি মস্ত বড় অপচয়ের, সে অপচয় তার নিজের জন্য বেদনার, তার আপনজনদের জন্য দুঃখের এবং যে জনপদের তিনি মানুষÑ তার জন্য কিছু পরিমাণে হলেও ক্ষতিকর। একাত্তরে আমরা বহু মেধাবান মানুষকে হারিয়েছি, জীবিত থাকলে তারা আমাদের অগ্রগতিতে সাহায্য করতে পারতেন। শত্রুপক্ষ তাদেরকে হত্যা করেছে। আর আমার এই শিক্ষক স্বেচ্ছামৃত্যুর পথই বেছে নিয়েছিলেন ঘাতকদের পক্ষে গিয়ে।

একাত্তরে ছোট বড় অসংখ্য ট্র্যাজেডি ঘটেছে, তার ঘটনাটিও একটি ট্র্যাজেডি বটে। অপচয়মূলক ও দুঃখজাগরণকারী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের সমাজ স্পষ্ট ও গভীরভাবে দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শত্রু ও মিত্রের পক্ষে-বিপক্ষে দুইভাগ। কিন্তু এই বড় দুইভাগের মধ্যেও ছোট ভাগ ছিল এবং সেই ভাগ সামাজিক সত্য। আর সত্য, হতাশা আছে বাংলাদেশে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তো অনেক বড় দৃষ্টান্ত। ধনবৈষম্য বাড়ছে এবং শ্রেণি শোষণ যেভাবে বাড়ছেÑ এর বিপক্ষে শ্রেণি সচেতনতা নেই। পাকিস্তানপন্থিদের সম্পর্কে সমাজ ও প্রগতিবাদী রাজনীতিকরা এখনও সেভাবে কি সজাগ?


  • শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা