× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দ্বৈত নাগরিকত্বের সম্ভাবনা ও সমস্যা

ড. আমেনা মহসিন

প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩ ১৪:১৬ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

বাংলাদেশিদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের পরিসর আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগে ইউরোপ আমেরিকাসহ মোট ৫৭টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা পাওয়া যেত। নতুন করে আরও ৪৪টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া হবে এবং এ বিষয়ে এসআরও জারি করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ১২টি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১২টি এবং ওশেনিয়া মহাদেশের ১টি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা পাবে বাংলাদেশিরা। তবে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কেউ এ সুবিধা পাবেন না তা বলা হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকের এ সিদ্ধান্তে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন এ সিদ্ধান্তে আমাদের ক্ষতি হবে। আবার অনেকে এর ভালো দিকও দেখতে পাচ্ছেন। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন সিদ্ধান্তের ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক নিয়ে অত ভাবার কিছু আপাতত নেই। কারণ এ সুবিধা অতীতেও ছিল। সম্প্রতি সুযোগের পরিসর বাড়ানো হয়েছে মাত্র। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা ইতিবাচক কিছু দেখতে পেয়েছেন বলেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আমার ধারণা।

দ্বৈত নাগরিকত্ব বলতে দুটো দেশের নাগরিকত্ব একই সঙ্গে থাকাকে বোঝায়। অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিকত্বের মাধ্যমে এক সঙ্গে দুটো পাসপোর্ট রাখার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের সব দেশ তাদের নাগরিকদের এ সুবিধা দেয় না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ সুযোগ নেই। আবার পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রয়েছে। আমাদের এই ভূখণ্ডের বাইরে হাতেগোনা কয়েকটি দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ আছে। এ সুবিধা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দ্বৈত নাগরিকত্ব সুবিধার ফলে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ বলছেন, দ্বৈত নাগরিকত্ব সুবিধা দেওয়া হলে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ার সুবিধা বাড়বে। তবে এখানে মূলত নাগরিকত্বের ধারণাকে আমলে আনতে হবে। নাগরিকত্ব ধারণাটির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি জড়িয়ে আছে। একজন নাগরিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে বাধ্য। আবার রাষ্ট্রকেও তার নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তবে রাষ্ট্র যদি দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ দেয়, তাহলে তার পেছনে একটি পরিকল্পনা থাকে। যদিও বাংলাদেশিদের এতগুলো দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ কেন দেওয়া হলো তা নিশ্চিত নয়।

বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ব নাগরিক ধারণার প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগও বাড়ছে। আমাদের দেশের অনেকেই বিভিন্ন দেশে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ বাইরের দেশের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে নাগরিকত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে নতুন একটি দেশের নাগরিক হলেও একজন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব রাখতে পারবেন। তাই নাগরিকত্বের বিষয়টি ব্যক্তির নিজ সিদ্ধান্ত ও নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সিদ্ধান্তে আমাদের স্বার্থ আদৌ ক্ষুণ্ন হয়েছে কি না।

এসব ভাবার আগে দ্বৈত নাগরিকত্বের ফলে আমাদের কি কি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে তা বিবেচনা করা জরুরি। বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সম্ভাবনা-সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টায় মানুষ নতুন কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রও বিশ্বায়নের সুবিধা কাজে লাগাতে চায়। দ্বৈত নাগরিকত্বের পরিসর বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সম্ভবত নীতিনির্ধারকরা সেসব সুবিধাই দেখতে পেয়েছেন। কারণ যারা আরেকটি দেশের নাগরিকত্ব নেবেন তারা সেখানে কর্মসংস্থান খুঁজে নিতে পারেন অথবা আয়-উপার্জনের অন্য পথ খুঁজতে পারেন। ব্যবসা-বাণিজ্যও চালু করতে পারেন। এই ব্যবসার পরিসর বাংলাদেশেও নিয়ে আসাটা অস্বাভাবিক প্রত্যাশা নয়। হয়তো এই সুযোগ দিয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ আনার একটি সুযোগ দেখতে পাচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা। আমাদের দেশ থেকে যারা বিদেশে শ্রমের জোগান দিতে যান তাদের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে। এমনকি কাজ পাওয়ার কিংবা কাজের পরিসরও অতটা বিস্তৃত নয়। কিন্তু ওই রাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষেত্রে তেমন প্রতিবন্ধকতা নেই। দ্বৈত নাগরিকত্ব পেলে তাদের জন্য অন্য একটি দেশে কাজ খুঁজে পাওয়া সহজ হবে, এমনকি কাজের পরিসর অনেক ক্ষেত্রেই বাড়বে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। দ্বৈত নাগরিকত্ব সুবিধা বাড়ানোর পেছনে এটিও একটি বড় কারণ হতে পারে। বিশ্বায়নের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারে অর্থনীতিকে সচল করার স্বার্থেও এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

তবে দ্বৈত নাগরিকত্বে সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি কিছু সমস্যাও তৈরি হয়। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ দেখতে পাই, তেমনি আমাদের অর্থ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। আগেই বলেছি, একজন নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হয়। অর্থাৎ একজন নাগরিক রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা ভোগ করেন। উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকত্ব না থাকলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে নাগরিকরা ওই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরাসরি আমানত রাখতে পারেন। অর্থাৎ আইনি প্রক্রিয়াতেই দেশের অর্থ বিদেশে নিয়ে যাওয়া যাবে। আর অন্য একটি দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার পর সেখানে বসবাস করা শুরু করলে নিত্যদিনের খরচাপাতি কিংবা সুযোগ-সুবিধা ওই রাষ্ট্র থেকেই নেবেন। সেদিক থেকে আমাদের কাছে সব সময় বৈদেশিক মুদ্রা আসবে এমনটা প্রত্যাশিত নয়।

একটি বিষয় লক্ষ্য করা জরুরি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ আসে শস্তা শ্রমের বিনিময়ে। আমরা দেখছি, শ্রমিকের কষ্টার্জিত অর্থই রেমিট্যান্স আকারে আসে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষরা উন্নত দেশগুলোর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের অর্থ গচ্ছিত রাখেন। দ্বৈত নাগরিকত্ব সুবিধা পাওয়ার পর তাদের দুই দেশেই কর দিতে হয়। কিন্তু কেউ কেউ জন্মভূমির সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ বিদেশে নিয়ে যান। তাদের বক্তব্য, যেহেতু এখানকার সম্পত্তি তাদের ব্যবহার করা হয় নাÑ তাই অহেতুক কর না দিয়ে বিক্রি করে দেওয়াই ভালো। যদিও বিক্রির প্রক্রিয়া অনুসরণে তাকে কর দিতে হয়। তার পরও নিয়মিত কর পাওয়ার সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হতে পারি।

উন্নত বিশ্বের দেশে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা বাড়লে বাইরে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়াতে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। দেশের মানুষ এখনও বাইরের দেশের সম্ভাবনাকে বড় বলে মনে করে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে নানা প্রতিবন্ধকতা ও ঘাটতি রয়েছে। তার পরও এ খাতে আমরা অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে পেরেছি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞান ব্যবহার করা এখন আমাদের দেশে অসম্ভব কিছু নয়। এমনকি আমাদের চিকিৎসকরা দুর্যোগকালে পেশাদারিত্বের পরিচয়ও দিয়েছেন। তারপরও অনেক মানুষ এখনও চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানের চিকিৎসার প্রতি তাদের এক ধরনের আস্থা রয়েছে। এই প্রবণতা নাগরিকত্বের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এই সিদ্ধান্তের ফলে মেধা পাচারের উদ্বেগ কিছুটা হলেও বাড়ছে। আমরা যদি আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকাই তাহলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির অনেক সন্তানেরই দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। কিন্তু তারা কোনোদিন দেশে ফিরে আসবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। এর প্রভাব কেমন হতে পারে তা শিক্ষা খাতের দিকে তাকালেই বোঝা সহজ হবে। কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সচ্ছল কিংবা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের অংশগ্রহণ কমছে। এই শ্রেণির সন্তানরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার চেষ্টা করছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রান্তিক পর্যায়ের অনেকেই আসছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের সমাহারের বিষয়টি তো নিশ্চিত হচ্ছে না। এটিও আমাদের শিক্ষা খাতের একটি বড় সমস্যা।

দ্বৈত নাগরিকত্বের এ সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ থাকতে পারে। আমরা কিছু ইতিবাচক দিক অনুমান করতে পারি। কিন্তু এর ফলে দৃষ্টিগ্রাহ্য সমস্যাও তৈরি হয়ে গেছে। দেশ থেকে অনেকেই বিদেশে চলে যাওয়ার পথ খোঁজেন কিনা, এই প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আগামী প্রজন্মের জন্য কি লিগ্যাসি আমরা রেখে যাচ্ছি তা যেন স্পষ্ট নয়। যদি এ লিগ্যাসি নির্ধারণ না করা যায়, তাহলে কীভাবে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আনুগত্য নিশ্চিত করা যাবে তাও ভাবনার বিষয়।

 


  • আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা