আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৩ ১৫:৩৯ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
ভারতের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বাণিজ্য ও যোগাযোগ খাতে ভারতীয়দের বিনিয়োগ বেড়েছে এবং রাজনীতিতেও ভারতের প্রভাব রয়েছে। দুই দেশের সরকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বরাবরই আগ্রহ দেখাচ্ছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন জওহরলাল নেহেরু। ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তিনি ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম করার পরিকল্পনা নেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বও ভালোভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করতে হলে বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। পরিকল্পনা অনুসারে একাধিক জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার এমন সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে ভারতের শীর্ষ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের জন্যও সুফল বয়ে আনে। নেহেরু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সময় নেওয়া সিদ্ধান্তই বর্তমান ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণের ফলে আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হয়। ফলে স্থানীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য দেশে ও দেশের বাইরে বড় পরিসরে বাণিজ্যের সুযোগ বাড়ে। এর মধ্যে একাধিক শিল্প খাত গড়ে ওঠে। এ সময় অটোমোবাইল শিল্প খাতের প্রসার ঘটতে শুরু করে। আস্তে আস্তে ভারতের শিল্পবাণিজ্যের প্রতিটি খাতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আধিপত্য নিশ্চিত হয়।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ভারতে
প্রকৃত অর্থে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত
করার মাধ্যমে বড় আকারের পুঁজি নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি বড় কনগ্লুম্যারেট প্রতিষ্ঠার সুযোগ
ও সম্ভাবনা তৈরি হয়। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা থাকায় জনগণের সম্পত্তি ভোগদখলের ক্ষেত্রেও
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান উৎসাহী হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক রাজ্যের রাজধানী, বেসরকারি কোম্পানি
এবং বহুজাগতিক প্রতিষ্ঠানÑ এই ত্রয়ীর সমন্বয় গড়ে ওঠে ভারতীয় অর্থনীতি। পুঁজির আধিপত্য
একীভূত হয়ে আরও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা সেখান থেকেই বাড়তে শুরু করে। টাটা
এবং বিড়লার মতো বড় করপোরেশনগুলো মূলত এদিকেই এগোচ্ছিল। আদানি ও আম্বানি এই পদযাত্রায়
আরও পরে যোগ দেয়। ভারতের বাণিজ্য আন্তর্জাতিক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। এখনও আদানি গ্রুপ নিজেদের
বহুজাগতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে তারা বড় পরিসরেই কার্যক্রম
চালাতে শুরু করেছে।
গত ১০ বছর ধরে আম্বানি গ্রুপ
এবং আদানি গ্রুপ নিজেদের বহুজাগতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। ২০১৮-এর পর থেকে এখন পর্যন্ত
এই দুই গ্রুপের সম্পদের পরিমাণ ১১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৪৫২ বিলিয়ন মার্কিন
ডলারে পৌঁছেছে। অর্থাৎ গত চার বছরে এই দুই গ্রুপের সম্পদ চারগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে গৌতম
আদানি বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে গেছেন। আদানিকে দেখলে ভারতে
বৈষম্যের চিত্র স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যে দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ মানুষ দারিদ্র্যের
কশাঘাতে মানবেতর জীবনযাপন করছে, সেখানে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সব সম্পদ পুঞ্জীভূত
হয়ে আছে। ভারতের পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য যেন কোনোভাবেই থামার নয়।
আদানি আর আম্বানিÑ এ দুটি গ্রুপই
গুজরাটের। সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর তাদের ব্যবসার পরিসর বেড়েছে। তাদের
সম্পদ বাড়ার পেছনে দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত ক্ষমতাসীনরা তাদের ব্যবসা পরিচালনায় নানাভাবে
সহায়তা করেছে। দ্বিতীয়ত, প্রাইভেট সেক্টরে তাদের যোগাযোগ ভালো। বিশেষায়িত অর্থনৈতিক
অঞ্চলের লিজ-সাবলিজ পাওয়া, দরকষাকষির সুবিধা, বেশ কয়েকটি সমুদ্রবন্দরের মালিকানা প্রাপ্তি,
বনাঞ্চলের জমি অধিগ্রহণ, রিটেইল মার্কেটে একচেটিয়া আধিপত্য, সরকারি নীতিমালার বদৌলতে
কর মওকুফের সুবিধা, শেয়ারবাজারে আধিপত্য বাদেও অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের
মতো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নÑ এসব সম্ভব হয়েছে সরকার থেকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা
পাওয়ায়। ব্যাপকহারে বেসরকারিকরণের ফলে পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোও বেসরকারি ব্যবসায়ীদের
কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। আদানি এবং আম্বানি এরই সুফলভোগী।
ভারতের বর্তমান সরকার তাদের
অনুগত করপোরেট গ্রুপকে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যবসা বাড়ানোর অনেক সুযোগ করে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ,
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কার
রাষ্ট্রপতিকে আদানি গ্রুপের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের অনুরোধ করেন। চুক্তিটি শ্রীলঙ্কার
জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় ভালো কিছু হতে পারে না। জনসম্মুখে এ রকম তথ্য ফাঁস করায় ওই
কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই একটি ঘটনাই সাক্ষ্য দেয়, ভারতের অনেক
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে বড় কনগ্লুম্যারেটের পরোক্ষ সম্পর্ক আছে। ইতোমধ্যে আদানি
গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ভারতের একাধিক সমুদ্র ও বিমানবন্দর। গ্রুপটি ভারতীয় বনাঞ্চলের জমি
অধিগ্রহণ করে কয়লার খনি খুঁজে বের করেছে এবং নতুন খনির সন্ধানে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা
করছে। বেশ কয়েকটি খনি থেকে ইতোমধ্যে কয়লা খননের কাজও শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারতের
প্রধান কয়লা আমদানিকারকও এই আদানি গ্রুপ। মূলত অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত খনি থেকে কয়লা
উত্তোলন করে তা ভারতে এনে এনটিপিসির (ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন) কাছে সরবরাহ
করা হয়। উল্লেখ্য, ভারতের বিদ্যুতের এক পঞ্চমাংশের জোগান গুটিকয়েক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
দিয়ে থাকে। প্রতিটি খাতেই এসব বৃহৎ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
বিশেষত অবকাঠামো খাত, তাপ ও বিদ্যুৎ খাত, সমুদ্র ও বিমানবন্দর এবং পণ্যদ্রব্যের বাজারে
তাদের আধিপত্য স্পষ্টতই দৃশ্যমান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য বাংলাদেশের
ওপরও পড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যবৈষম্য
ব্যাপক। মূলত ভারতের তরফে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক আদায় বাদেও নানা প্রতিবন্ধকতা আছে।
অথচ বাংলাদেশে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার পর ভারতীয় কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বহনের খরচ
এক-চতুর্থাংশ কমাতে পেরেছে। ভারতীয় বহুজাগতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে টাটা এবং আরও কিছু
কোম্পানি অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এমনকি ভারতের
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নানা প্রতিষ্ঠান যেমন এনটিপিসি এবং ওএনজিসি-ও (অয়েল অ্যান্ড
ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন) এখানে সক্রিয় আছে। আম্বানি গ্রুপের পাশাপাশি আদানি গ্রুপও
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে। বাজারে কোনো অদৃশ্য হাত তো আর
তাদের টেনে আনেনি। মূলত রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমেই তারা আমাদের বাজারব্যবস্থায় ঢোকার
সুযোগ পেয়েছে। বিগত বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যকার বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার ক্ষেত্রে
আদানি ও আম্বানি গ্রুপকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত আদানি
গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ
হওয়ার পরও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিদ্যুৎ খরচ না করেই
আমাদের ক্যাপাসিটি খরচ মেটাতে হবে। সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কয়লাচালিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও
বোধহয় আদানি গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। কারণ তারাই এনটিপিসি-কে কয়লা সরবরাহ করে।
আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এমনকি
এখানকার সমুদ্র ও বিমানবন্দরগুলোর প্রতিও তাদের আগ্রহ আছে। বাংলাদেশে বড় পরিসরে ঠিকাদারি
প্রকল্প পরিচালনার বিষয়েও তাদের তোড়জোড় চোখে পড়ছে। বাংলাদেশের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক
অঞ্চলগুলো ভারতের কাছে হস্তান্তর করা মানে এর কর্তৃত্ব আদানি গ্রুপের হাতে চলে যাওয়া।
বাংলাদেশের পণ্যদ্রব্যের বাজার, ঠিকাদারি ব্যবসার, জ্বালানি খাত এবং স্পেকুলেটিভ বাণিজ্যে
নিজেদের কার্যক্রম বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে গ্রুপটি।
পরিশেষে, এই গ্রুপগুলো বড় পরিসরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আস্তেধীরে নিজেদের ব্যবসায় কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর জন্যও নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও জানি না এ দুটো গ্রুপ আদৌ কতটা স্বচ্ছভাবে তাদের ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করবে। আমরা এও জানি না, এ দুটো গ্রুপ আমাদের দেশে বাণিজ্য শুরু করলে কেমন ফলাফল পাওয়া যাবে। আপাতত এটুকু নিশ্চিত, ভারতের পুঁজিবাদী সত্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। চাকরির বাজার হিসেবে বাংলাদেশ বহু আগে থেকেই ভারতীয়দের প্রধান লক্ষ্য। ভারতীয়দের চাকরির বাজার, দেশটির সরকারের সহযোগিতা এবং বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ভবিষ্যতে যে এর পরিমাণ আরও বাড়বে তা বলে দিতে হবে না। আপাতত বাংলাদেশের কনগ্লুম্যারেট প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহকারী হিসেবেই উপস্থিত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।