মার্চ ১১ ১৯৭১
অলঙ্করন : প্রবা
১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ফলে উত্তাল হয়ে উঠতে থাকে পুরো পূর্ব পাকিস্তান। প্রতিদিনই নতুন নতুন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে মানুষ পেয়ে যায় দিকনির্দেশনা। কার কি দায়িত্ব, কীভাবে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবেÑ তার সঙ্গে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে উপযুক্ত সময়ের।
এদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাও নানাভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। যত সময় গড়ায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তত উত্তপ্ত হতে থাকে। অবস্থার গুরুত্ব বুঝে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। এ তারবার্তায় জনাব ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতিতে সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘উদ্ভূত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমরা আজ বিরাট সংকটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করতেই হবে।’ এদিন পাকিস্তানের করাচিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলেন গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন বাংলার সরকার। সেখানে সব সরকারি কর্মচারী এবং সচিবরা তার নির্দেশ পালন করছেন। ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দুই অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।’ পূর্ব বাংলার মানুষ মেনে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সকল দিকনির্দেশনা। তার নির্দেশ মেনেই হাইকোর্টের বিচারক এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সারা বাংলার সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারীর অফিস বর্জন করছেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলার মানুষের এই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও। তিনি ১১ মার্চ টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বলেন, ‘বাঙালির স্বার্থের প্রশ্নে আপস করার দিন চলে গেছে।’ তিনি এ জনসভায় সাত কোটি বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ পালন করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১১ মার্চ পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর কলেবর কমে নেমে আসে মাত্র ৪ পাতায়। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের কাগজ মার্চের শুরু থেকেই পাকিস্তানের যাওয়া বন্ধ হওয়ায় ১৪ পাতার সংবাদপত্রগুলোকে কলেবর কমিয়ে দিতে হয়। এদিন কুমিল্লা কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পাঁচ কয়েদি।
বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে পালিয়ে যায় ২৪ কয়েদি, দুজন নিহত হয় পুলিশের গুলিতে। দৈনিক ইত্তেফাক ‘আঁতে ঘা’ শিরোনামে ১১ মার্চ একটি প্রতিবেদন ছাপে। সেখানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে করাচি শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি আহমদ আবদুল্লাহর পাঠানো তারবার্তার বরাতে লেখা হয়, পূর্ব বাংলা থেকে আর্থিক লেনদেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা আর্থিক দুর্দশার সম্মুখীন। তিনি সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
গ্রন্থনা : মামুন
রশীদ