ড. রাশেদা আখতার
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩ ১৫:৫৬ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় নারী দিবস। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
প্রতি বছরই জাতিসংঘ একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘প্রযুক্তি
ও উদ্ভাবন, লিঙ্গবৈষম্যের নিরসন’। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি
কীভাবে বৈষম্য দূর করবে? উত্তর : দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। প্রযুক্তি আমাদের নতুন কিছু শেখায়।
উদ্ভাবন কিংবা প্রযুক্তিÑ এ দুটো ক্ষেত্রেই দক্ষতার বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। আমরা প্রতি
বছর শ্রম রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি। শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি
নারীর অংশগ্রহণও বেড়েছে। যারা বাইরের দেশে কাজের জন্য যাচ্ছেন, তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা
অর্জন করতে হয়। সরকার এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। গ্রামীণ ও আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেক
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সেখানে মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনগত
দক্ষতা অর্জন করছে।
প্রযুক্তি যে বৈষম্য নিরসন করতে পারে, তার একটি উদাহরণ তৈরি
পোশাক খাত। তৈরি পোশাক খাতের মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি। তৈরি পোশাক কারখানায়
প্রতিটি শ্রমিকেরই রয়েছে আলাদা দায়িত্ব ও ভূমিকা। এ কাজগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা
জরুরি। যদি যন্ত্র পরিচালনায় তারা পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জন করতে না পারে, তবে সেখানে
তার টিকে থাকা কঠিন। সেই দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়েই কিন্তু শিল্প খাতে বা বিভিন্ন অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তাই প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা একেবারেই নেই
তা নয়। দেশে যারা তৈরি পোশাক খাতে কাজ করেন তারা গ্রামীণ অঞ্চলের। একসময় তারা চাকরি
ছেড়ে গ্রামে চলে যান। সেখানে গিয়ে হয়ে ওঠেন উদ্যোক্তা। এভাবে একজনের প্রযুক্তিদক্ষতা
অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু একটি বিষয় সত্য, প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে শুধু
নারী নয়, পুরুষও পিছিয়ে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ অস্বাভাবিক নয়।
মহামারির সময় ইন্টারনেট ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার আগের চেয়ে বেড়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে
অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ায় অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েরা মোবাইল-ফোন ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগ
পেয়েছে। মহামারির কারণে আমরা জীবনযাপনের এমন এক পদ্ধতির সঙ্গে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি,
যার সঙ্গে প্রযুক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি
সম্পর্কে আমরা এখনও সচেতন নই। সাইবার বুলিং বা ইন্টারনেটের অনৈতিক ব্যবহারের বিষয়টিও
একটি সামাজিক সমস্যা। তাই দেশে হঠাৎ প্রযুক্তিগত জীবনযাপনের একটি পর্যায় শুরু হওয়ায়
এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
প্রযুক্তি মানে শুধু মোবাইল ফোন কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার বোঝায়
না। প্রযুক্তির পরিধি আরও ব্যাপক। এখন প্রত্যেকের হাতেই স্মার্টফোন। আমাদের শুধু প্রযুক্তিগুলো
মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও
নারীর নিরাপত্তা কমছে। বিভিন্ন মহল থেকে একই প্রশ্ন আসছে বারবারÑ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত
হবে কীভাবে? আমি পাল্টা প্রশ্ন করতে চাইÑ নারী কিংবা পুরুষ, কেউ কি নিরাপদ? নারী দিবস
মানে শুধু নারীর নিরাপত্তা বিধান নয়। নারী ও পুরুষ উভয়ের সমতা নিশ্চিত না হলে সার্বিকভাবে
সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। শুধু নারীর নিরাপত্তার কথা ভাবলে
বড় চিত্রটা এড়িয়ে যাওয়া হয়। প্রতিপাদ্যের পরের অংশটিও ভেবে দেখা জরুরি, লিঙ্গবৈষম্য
নিরসন না করলে মুক্তি নিশ্চিত হবে না। নিরাপত্তা প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় অবধারিতভাবেই
আসে, আয়তনের তুলনায় আমাদের জনসংখ্যা এত বেশি যে, ঘরে ঘরে পৌঁছে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব
নয়। এটি একটি বাস্তবতা। আমাদের নারী কিংবা পুরুষ উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সামাজিক
দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টিকে ছোট করে দেখার অবকাশ ক্ষীণ। এজন্য অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে
হবে। আজ সবার হাতে মোবাইল ফোন থাকায় যোগাযোগ সহজ হয়েছে। আবার দুশ্চিন্তাও বেড়েছে। বেশ
কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, অভিভাবকরা মেয়েসন্তানের গতিবিধি নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তায়
ভোগেন। এটি সামাজিক ব্যবস্থার কারণেই মানুষের মনে এমন প্রভাব রেখেছে। কিন্তু অভিভাবকদের
বুঝতে হবে, সন্তানকে সঠিকভাবে প্রতিপালন করা গেলে লিঙ্গবৈষম্য দূর করা সম্ভব।
দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন আছে। কিন্তু সেসব বাস্তবায়ন
করা যাচ্ছে না শুধু সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। সচরাচর কারও বাড়িতে চুরি হলে সবাই
চোরকে সাজা দিতে ব্যস্ত হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ স্থানেই যার বাড়িতে চুরি
হয়েছে তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এগুলো সামাজিক ভাবনাপ্রসূত সমস্যা। আইনও অনেক সময়
সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার জালে আটকা পড়ে সমঝোতার পথ নেয়। নারী দিবসে লিঙ্গবৈষম্য
দূর করতে হলে এ বিষয়টি আমাদের অনুধাবন করতে হবে। সন্তান পরিপালন ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে
মূল্যবোধের ধারণাগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। সচরাচর আমাদের সমাজে নিষেধের তর্জনী অথবা আদরে
ঢেলে দেওয়াÑ এ দুই উপায়ে সন্তান প্রতিপালন করা হয়। অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে অধিকাংশ
বিষয়েই আলোচনা করেন না। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সন্তানকে কখনও ‘না’ বলা যাবে না। কিন্তু
সব ক্ষেত্রেই তো আর ‘হ্যাঁ’ বলা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে হ্যাঁ ও না-এর সমন্বয়ের একটা পথও
থেকে যায়। আমরা যখন সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তাদের সচেতন করে তুলতে পারব, তখন প্রযুক্তির
ব্যবহারে তারা যেমন পরিমিতিবোধ অর্জন করবে, তেমনি অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের বিষয়েও
সচেতন হবে।
দেশে নারীবাদ নিয়ে এখনও অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অবশ্য নারীবাদ সম্পর্কে কিছু মানুষের মন্তব্যও এর পেছনে দায়ী। আবার কেউ নারীকে নিয়ে কথা বললে তাকে নারীবাদী বলা হয়। এমন বিভেদ সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে হচ্ছে। শুধু প্রযুক্তির অপব্যবহার ও সব জায়গায় প্রযুক্তি নিতে না পারার জন্য নয়। একজন মানুষ হিসেবে আমার অধিকার রয়েছে আমার কথা আমি বলব। আমার অধিকার সম্পর্কে আমি সচেতন। এমন এক সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার সামাজিক ও পারিবারিক দায় এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুফল ভোগ করতে হলে প্রথমেই আমাদের নিজ সামাজিক কাঠামোয় মূল্যবোধের পরিবর্তন আনতে হবে।