× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যে ব্যাধির উপশম হয়নি আজও

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩ ০০:৩৪ এএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

স্মরণ করছি লিও তলস্তয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সেই কবে সমাজ, রাজনীতি, মানুষের জীবনাচার নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে গিয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিক লিও তলস্তয় বলেছিলেন, একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে সে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মের লড়াই লাগিয়ে দিলেই চলবে আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ধর্মের দেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মারে তাদের কথাগুলো আজও খুব প্রাসঙ্গিক এই কথাগুলো নতুন করে স্মরণ করার প্রেক্ষাপট পঞ্চগড় পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসাতথা বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালে মার্চ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রাণহানি, রক্তপাত, অগ্নিসংযোগ ভাঙচুরের ঘটনায় আবারও ওই কথাই মনে হয়েছে, এখনও গেল না আধার বিগত দিনে দেশে যত সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে এর সিংহভাগই ঘটেছে গুজবকেন্দ্রিক পঞ্চগড়ের ঘটনাও এর ব্যতিক্রম নয় আমাদের দেশে পোলিও, গুটিবসন্ত ইত্যাদি নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম ঘটলেও সাম্প্রদায়িকতা নামক ব্যাধির উপশম স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পরও হয়নি

মার্চ মাস আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মার্চেই তো বাঙালি জাতি স্বাধীন ভূখণ্ডের মানবিক চেতনার যে দেশের স্বপ্ন লালন করে আসছিল এর বাস্তবায়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায় একাত্তর পর্ব আমাদের বাঁক পরিবর্তনের নিশানা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল সাম্প্রদায়িকতার নিরসন তা হয়েও ছিল রক্তগঙ্গা পেরিয়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সেই দেশে একাত্তরে মাটিচাপা দেওয়া সাম্প্রদায়িকতার ভূত আবার অপছায়া ফেলবে, তা ছিল অচিন্তনীয় পঁচাত্তরের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হোতারা সপরিবারে শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই হত্যা করেনি; হত্যা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সব প্রত্যাশা-স্বপ্ন পদপিষ্ট করে তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তি দেশকে নিয়ে যেতে শুরু করে পেছনের দিকে ওই অন্ধকারাচ্ছন্ন, জীবনবৈরী পরিস্থিতির নিরসন ঘটিয়ে ফের শুরু হলো দেশের সম্মুখযাত্রা কিন্তু তারপরও অপছায়া পিছু ছাড়েনি নতুন প্রত্যাশা-স্বপ্ন যদিও সাধারণ মানুষের চেতনায় লালিত ছিল, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির মেরুকরণের সমীকরণে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পায়নি আজও অন্ধকার রয়েই গেল রাজনীতির মেরুকরণের সমীকরণে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বিভাজন আরও প্রকট হয়ে উঠতে থাকল দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই কিন্তু আমাদের রাজনীতির ধরনটা হলো, পদে পদে মনে করিয়ে দেওয়া হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরবিরোধী দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠী মানবিক চেতনার মানুষের জন্য এমন এমনটি অকল্যাণ ডেকে আনল ব্রিটিশের তৈরি ভ্রান্ত ইতিহাস আমরা নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়েছি, পদে পদে তাকে ঘাড়ে বয়ে চলেছি কে জানত স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পরও ওই ভ্রান্ত চেতনা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না?

সাম্প্রদায়িকতা নয়, চাই মানবিক বাংলাদেশÑ এই স্লোগান প্রগতিবাদী নানা মহলের তরফে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে কিন্তু তা যেন স্বপ্নের বৃত্তবন্দি ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ক্রমবর্ধমান চিহ্নিত সমস্যা সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, বৈষম্য, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন এমনকি স্বধর্মের আন্তঃকোন্দল এবং জঙ্গিবাদ ধর্মীয় উগ্রবাদ ইত্যাদি সম্পৃক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান নিয়ে কিছু বলতে গেলে ইতিহাসের পাঠ নিতে হয় থাক, আপাতত না- বা নিলাম সেই পাঠ পঞ্চগড়ে যে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে গেল তা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের দুই পক্ষের বিদ্বেষ থেকে সৃষ্ট আহমদিয়া-শিয়া-সুন্নি সবাই ইসলামের অনুসারি হলেও সম্প্রদায়গত বিভাজনের দেয়াল রয়েছেএকটি সম্প্রদায়কে অন্যরাতো মুসলিমই স্বীকার করে না দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই সম্প্রদায়-বিভাজন সামাজিক স্থিতিশীলতা ধর্মীয় সহাবস্থানের জন্য শুধু প্রতিকূলই নয়, একে কেন্দ্র করে ক্ষতের ওপর ক্ষত সৃষ্ট হওয়ার বহু নজিরও এই স্বাধীন বাংলাদেশেই রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, সামাজিক শক্তিও কতটা গুরুত্বপূর্ণÑ নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল এবং সংবিধানে তা লিপিবদ্ধও হয়েছিলÑ এরও সুরক্ষা দেওয়া যায়নি রাজনৈতিক হীনস্বার্থের কারণেই বাহাত্তরের সংবিধানে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য নির্যাতন রুখে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয় কিন্তু সেই অঙ্গীকার শুধু মলাটবদ্ধই রইল বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে এবং এরই সাম্প্রতিক সর্বশেষ নজির পঞ্চগড়ে সহিংসতা এবং পৈশাচিক ঘটনা

সাম্প্রদায়িকতা অপরবিদ্বেষের বিরূপ ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এর বহু নজিরই আমাদের সামনে আছে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বাপর ইতিহাসে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে নানা অজুহাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার যে হিংস্র উন্মাদনা লক্ষ করা গেছে, তাতে সংগতই ফিরে ফিরে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছেÑ এই কি আমাদের সেই বাংলাদেশ আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ কিংবা ভারতে সাম্প্রদায়িক কোনো ঘটনা ঘটলে দুই দেশেই শুরু হয় বিদ্বেষী অপসংস্কৃতির চাষ এসবই ক্রমে ক্রমে ডালপালা মেলে এবং সমাজের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে এর ওপর ভর করেই প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্ম-বর্ণান্ধ রাজনীতি, দখল-লুণ্ঠনের অর্থনীতি বেড়ে ওঠে আমরা এও দেখেছি, যারা এসবের সুবিধাভোগী, তারা এই বিদ্বেষ চাষে খুব তৎপর থাকে মনে রাখা জরুরি, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণ হয়েছে অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শক্তিতে এবং এই শক্তিই আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি কিন্তু সেই ভিত্তিতে ফাটল ধরানোর চেষ্টা সেই পঁচাত্তরে শুরু, এখনও তা নানা কৌশলে চলছে

নাগরিক অধিকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ রয়েছে এরমধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা অধিকার অন্যতম কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আইনবহির্ভূত কারণে দেশে বিপন্ন বোধ করে এমন মানুষের সংখ্যা অসংখ্য পঞ্চগড়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে ইতঃপূর্বে এমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রশক্তির তরফে বারবার শোনা গেছে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে রাজনৈতিক সম্প্রদায়গত পরিচয় ন্যায়বিচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি পুনরায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পথ আরও প্রশস্ত করে দিয়েছে সমাজে সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরির দায়টা যেমন রাষ্ট্রশক্তির রাজনৈতিক দলের তেমনি সামাজিক শক্তির ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় আমরা দেখছি, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে দিতে কারা বারবার কলকাঠি নেড়েছে প্রতিবারের মতো এবারও শুধু প্রত্যাশাই করি, পঞ্চগড়ের পৈশাচিক-বর্বরোচিত ঘটনার যথাযথ আইনি প্রতিকার নিশ্চিত হবে এবং মনুষ্যত্বের পরাজয় ঠেকাতে রাষ্ট্রশক্তি কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করবে একজন নাগরিক শুধু ধর্মীয় কিংবা সম্প্রদায়গত পরিচয়ের কারণে আক্রান্ত হবেন, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?


  • সাংবাদিককবি  লেখক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা