৪ মার্চ ১৯৭১
১৯৭১ সালের মার্চকে
বলা হয় অগ্নিঝরা মার্চ। সেই উত্তাল ও উন্মত্ত দিনগুলো ছিল ঘটনাবহুল। প্রতিটি মুহূর্ত
পাল্টে যাচ্ছিল স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ মানুষের পদচারণায়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের
মধ্য দিয়েই জাতি বুঝে যায় ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের টালবাহানা। প্রতিবাদে উত্তাল
মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে স্বাধীনতার স্পৃহা। জাতিকে সামনে থেকে পথ দেখান বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের কবর
রচিত হওয়ার অধ্যায়ের সূচনা। মার্চের শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে
থাকে পাকিস্তানিরা। ৪ তারিখ থেকে অঘোষিতভাবে ঢাকাসহ সারাদেশে চলতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবের শাসন।
এদিন এক বিবৃতিতে
বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনোদিন কোনো জাতির মুক্তি
আসেনি।’ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বানে সাড়া দেওয়ায় তিনি সবাইকে অভিনন্দন
জানান। সেই সঙ্গে ৫ ও ৬ মার্চ আবারও সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের
আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনও বেতন পাননি, শুধু
বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।’ একই সঙ্গে স্টেট ব্যাংক বা
অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলাদেশের বাইরে টাকা না পাঠানোরও নির্দেশ দেন। আগের তিন দিনের
মতো এদিনও সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালে সান্ধ্যআইন উপেক্ষা করে অসংখ্য মানুষ রাস্তায়
নেমে আসে। হরতাল চলাকালে খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬ জন শহীদ হন। চট্টগ্রামে দুদিনে
প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন এক জরুরি সভায়
বাংলার জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি
জানায়। সভা থেকে ৬ মার্চ সাংবাদিকদের মিছিল এবং বায়তুল মোকাররমে সমাবেশের কর্মসূচি
ঘোষণা করা হয়। এদিন করাচি প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর
খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে
ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
রেডিও এবং টেলিভিশনে
কর্মরত বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেন। এদিন ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্র’ নাম পরিবর্তন করে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এবং ‘পাকিস্তান টেলিভিশন’, কেন্দ্র ‘ঢাকা টেলিভিশন’ কেন্দ্র
হিসেবে তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে। যতদিন পর্যন্ত দেশের মানুষ সংগ্রামে লিপ্ত
থাকবে, ততদিন পর্যন্ত ‘বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বেতার-টেলিভিশন শিল্পীরা না যাওয়ার
কথা ঘোষণা করেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন
স্থগিত ঘোষণার ফলে আওয়ামী লীগ যে চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা আশা করা যায় না। আওয়ামী
লীগের সঙ্গে ৬ দফা প্রশ্নে আলাপ-আলোচনার জন্য শুধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্বল্প সময়ের
জন্য স্থগিত ঘোষণার দাবি করেছিলাম মাত্র।’ভুট্টোর সান্ত্বনামূলক কথায় পরিস্থিতির মোড় ঘোরে না।
বরং পরদিনও সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি পালনের জন্য জনতা প্রস্তুতি নেয়।