প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের বিশ্লেষণ
ইয়ুমেই জি
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৩ ১৪:৪২ পিএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৩ ১৭:৪৯ পিএম
অলংকরণ : জয়ন্ত জন
যুক্তরাজ্যে এ
মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ কেন্দ্রীয়
ব্যাংক সুদ অস্বাভাবিক হারে নির্ধারণ করে চলেছে, যার প্রভাব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর
ওপর পড়ছে এবং জনজীবনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ইউরোপের অর্থব্যবস্থার দিকে তাকালে ২০টি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। তার মধ্যে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক চলতি
বছর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ১০৭ বিলিয়ন ইউরো ঋণ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি যদি
আমানত সংগ্রহ বাড়াতে পারে, তাহলে চলতি বছরেই আমানত বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ বাড়বে প্রত্যাশা
করা যায়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থে সুদের হার
৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে
শক্তিশালীকরণে এমন উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে।
মুদ্রার ক্ষেত্রে
এমন সিদ্ধান্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আয়ের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর
লোকসানের পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন,
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করে যদি সুদ পেয়েই
থাকে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পারিতোষিক নির্ধারণ করতে পারে। এমন প্রশ্নও দেখা
গেছে, মুদ্রানীতি তৈরি করার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুবিধার বিষয়টি আদৌ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া ছাড়াই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে চড়া সুদ দেওয়ার যৌক্তিকতা
নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে অবশ্যই।
অনেক অর্থনীতিবিদই
মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো রিজার্ভ রাখার বিনিময়ে সুদ আশা করতেই
পারে। ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৯৯৯ সালে প্রথম রিজার্ভ রাখার বিপরীতে সুদের প্রচলন
করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনও ২০০৮ সালে এমন ব্যবস্থা চালু করে। তবে ২০০০ সালের
আগেও বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত রাখার বিনিময়ে সুদ পেত না। সারা পৃথিবীতেই বিষয়টি আস্তে
আস্তে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, বাণিজ্যিক কোনো ব্যাংকই ডিমান্ড ডিপোজিটের বিপরীতে সুদ দেয় না। যদিও এ ধরনের আমানত অর্থনৈতিক তারল্য নিশ্চিত করে। সেদিক থেকে এ যুক্তিটি অবশ্যই ভালো—যদি ব্যাংকে আমানত রাখার জন্য ভোক্তাকে পারিতোষিক দিতে হয়, তাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংকও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পারিতোষিক দেবে। পারিতোষিক পাওয়ার বিষয়টির যৌক্তিকতা অনুধাবনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কীভাবে আয় করে তা খতিয়ে দেখা জরুরি। রাষ্ট্রীয় মুদ্রানীতি কার্যকর করার মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আয় করে থাকে। কিন্তু রিজার্ভের অর্থ রাখার জন্য সুদ দেওয়া হলে রাষ্ট্রীয় অর্থ বেসরকারি খাতে চলে যায়। অথচ এই সুদ একজন করদাতা থেকেই জোগাড় করা হচ্ছে। এই অর্থ রাষ্ট্রের হাতেই থাকা উচিত।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে পারিতোষিক নির্ধারণ করতে
পারলে মূল্যস্ফীতি এবং অর্থ সরবরাহকেন্দ্রিক সমস্যা অনেকাংশে দূর হবে। মুদ্রানীতি
সফলভাবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে এর বিকল্প খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। বিদ্যমান
পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জাতীয় পরিসরে সুদহার বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।
কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে ঋণ দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে
পারিতোষিক নির্ধারণের বিষয়টি ভাবনায় রাখা জরুরি। বাণিজ্যিক ব্যাংক ঝুঁকি নিয়ে
সুদহার নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সে সুযোগ আছে বিধায় তা
নেওয়া উচিত। বাণিজ্যিক ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ না দিয়েও বাজারের সুদহার
নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারি বন্ড বিক্রি বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক দেশই
বন্ড বিক্রি বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। এখানে সমস্যা হলো, কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের মুদ্রাতালিকা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে এবং এর বিপরীতে মুনাফা আসার হার অনেক ধীরগতিসম্পন্ন।
২০০৮ সালের আগে বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্যসংকট দেখা গিয়েছিল। তখনও
বন্ড বিক্রির মাধ্যমে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়েছে।
তবে ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে এখনও কোনো
উদ্যোগ নেয়নি। এখনও ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ ১ শতাংশই রয়েছে। কিন্তু এ সংখ্যার
হারে পরিবর্তন আনা জরুরি। না হয় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কেন্দ্রীয়
ব্যাংককে সরকারি বন্ড এবং ন্যূনতম রিজার্ভের পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যমে সংকট
সমাধান করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, রিজার্ভে সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি মুদ্রার
বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রিজার্ভের প্রবাহে ছোটখাটো পরিবর্তন আনতে পারলে
বাণিজ্যিক ব্যাংককে চড়া সুদে ঋণ দেওয়ার প্রয়োজনও থাকবে না। ব্যাংককেও ঋণ দিতে হয়।
সে ঋণ জোগানের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করা জরুরি। তবে কর আদায়ের
ক্ষেত্রে অনেক সময় অর্থনৈতিক সংকটও প্রবল আকার ধারণ করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয়
ব্যাংককে হিসাব করতে হবে প্রাপ্তির পারদ কতটা ভারী হচ্ছে।
সরকারি বন্ড বিক্রি এবং ন্যূনতম রিজার্ভের হার নির্ধারণের মাধ্যমে একাধিক সুবিধা পাওয়া যাবে। অর্থনীতিতে বিদ্যমান বিচ্যুতি পুরোপুরি হটিয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো সংকট দূর করা সম্ভব হবে না। এখানে বাণিজ্যিক ব্যাংককে অসুবিধায় ফেলে দেওয়ার একটি প্রসঙ্গ স্বভাবতই চলে আসে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংককে ঝামেলায় না ফেলেও তা করা সম্ভব। নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা থেকেই টান দেওয়ার পরিকল্পনা কষেন। এভাবে তারা অর্থনৈতিক ভারসাম্য অর্জনের চেষ্টা করেন বটে, কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হয় রাষ্ট্রের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা সরকারের কাছেই ফিরতে হবে। এ অর্থের সুফল করদাতারা ভোগ করবেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি এর সুযোগ-সুবিধা নিতে থাকে, তাহলে জনজীবনে কোনো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর : আমিরুল আবেদিন