মার্চ ১৯৭১ : ফিরে দেখা
ছবি : সংগৃহীত
বসন্তের দিনগুলো একাত্তরের মার্চের রাজপথে স্নিগ্ধ বাতাস ও পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছিল। মার্চের বসন্তেই বাংলাদেশের জন্মলগ্ন আরও এগিয়ে আসতে শুরু করে। তার শুরু ১ মার্চ। এদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুর ১টা ৫ মিনিটে এক বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ভাষণে বলেন,
‘পাকিস্তানের একাধিক জনপ্রতিনিধি আগামী ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তারা যেহেতু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পরিহার করতে চেয়েছেন;
সুতরাং জাতীয় পরিষদই ভেঙে যেতে পারত। এরপরও আমরা যদি ৩ মার্চ উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য এগিয়ে যাই,
তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমগ্র চেষ্টাই নষ্ট হয়ে যেত। সংবিধান রচনায় একটি যুক্তিসঙ্গত বোঝাপড়ায় আসার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের আরও সময় দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। পাকিস্তানের কয়েকটি দলের কঠোর মনোভাব ছাড়াও ভারত যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে,
তার ফলে সমস্ত ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আমি পরবর্তী ১ তারিখের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
প্রেসিডেন্টের বেতার বার্তার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। এবার কি তবে দাবি-দাওয়ার
বিষয়ে ফায়সালার পথ উন্মুক্ত হবে?
কিন্তু ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য তাদের আগ্রহকে ক্রোধে রূপ দেয়। বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। মুহূর্তেই ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার এই সিদ্ধান্ত জনবিরোধী এবং প্রতিহিংসামূলক বলেই মনে হয় বঞ্চিত-লাঞ্ছিত
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে। ঘোষণা শোনার পর ছাত্র-জনতাও
চুপ থাকেনি। তারা জড়ো হতে শুরু করে হোটেল পূর্বাণীর দিকে। কারণ সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যদের বৈঠকে ৬ দফা দাবির ওপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। এমন সময়ে জনতার মিছিলের শব্দে বৈঠক স্থগিত করতে হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনতার উদ্দেশে বলেন,
‘বাংলার মানুষ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতালের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সর্বাত্মক আন্দোলনের লক্ষ্যে নেতৃবৃন্দরা আলোচনা শুরু করেন।
একাত্তরের পহেলা মার্চ ছিল সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক গতিবিধি নির্ধারণের ঐতিহাসিক দিনক্ষণ। এদিনই পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বশীল নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক মনোভাবনায় আপস না করার বিষয়টি স্পষ্ট বুঝতে পারেন। কারণ ওইদিন রাতে আরেকটি ভয়াবহ খবর পাওয়া যায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান খ-অঞ্চলের
সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা এমএম ইয়াকুব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ছুতা দেখিয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। বসন্তের আবছায়ায় পহেলা মার্চ সেজন্যই গুরুত্বপূর্ণ। রক্তক্ষয়ী মার্চ এক ঐতিহাসিক মাস,
জাদুবাস্তবতার মোড়কে আঁকা।