× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অক্ষত রবীন্দ্রনাথের বিক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:০৭ এএম

অক্ষত রবীন্দ্রনাথের বিক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা

রবীন্দ্রনাথ গুম হয়ে গেছেন- এই ছিল সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম। তার দুই দিন পর খবর পাওয়া গেল গুম হওয়া রবীন্দ্রনাথের সন্ধান মিলেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কিন্তু কী অদ্ভুত, তার মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন! ঘটনাটি একটি ভাস্কর্য কেন্দ্র করে ঘটে গেলেও সমাজে যে অবক্ষয় ঘটছে, তারই প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে এ দৃশ্যে! অথচ চারদিক কেমন ভাবলেশহীন। যেন এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা তেমন কিছুই ঘটেনি। যেন সবকিছুর প্রতিবাদ শুধু ছাত্ররাই করবে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব; আমাদের কিছু বলার নেই, দেখার নেই।

দেশে মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর সেন্সরশিপ এবং সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ছাত্ররা ১৪ ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যটি স্থাপন করেছিল রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। ছাত্র ইউনিয়নের সহযোগিতায় ভাস্কর্যটি তৈরি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষার্থী। বাঁশ, থার্মোকল আর বইয়ের কাগজ ব্যবহার করে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভাস্কর্যে বিষণ্নমুখে দাঁড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখা গিয়েছিল। হাতে থাকা তার কাব্যগ্রন্থ 'গীতাঞ্জলি' ভেদ করেছে একটি পেরেক। রবীন্দ্রনাথের মুখে টেপের বাঁধন। বইমেলার টিএসসি-সংলগ্ন প্রবেশমুখে রাজু ভাস্কর্যের পাশেই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিলো। ফেব্রুয়ারি জুড়ে ভাস্কর্যটি সেখানে রাখা হবে বলে জানিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। অথচ ভাস্কর্য স্থাপনের দুই দিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে সেটি আর সেখানে দেখা যায়নি। ভাস্কর্য গুম করার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ওই স্থানে 'গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে একটি ব্যানার টানিয়ে ভাস্কর্য গুম হওয়ার প্রতিবাদ করে। অবশেষে ভাস্কর্যটির শরীর ও ভাঙা মাথার অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একেএম গোলাম রব্বানী ভাস্কর্য স্থাপনকে 'সৌন্দর্যহানি' বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, রাজু ভাস্কর্যের পাশে আরেকটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এটি সৌন্দর্যহানি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যখন এই কথা বলেন, বুঝতে বাকি থাকে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিক্রিয়াশীলতাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। প্রগতিশীলতার মুখোমুখি প্রতিক্রিয়াশীলতাকে দাঁড় করাতে রাজনৈতিক হীনস্বার্থ সিদ্ধির যে অভিযোগ আছে, তা উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। টেপ দিয়ে মুখবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের কাছে একটি প্রতিবাদের নাম। তারা নিপীড়নের বিরুদ্ধে এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে প্রতিবাদী হয়েছে। তারা অধিকতর মানুষের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতেই রাজু ভাস্কর্যের সামনে অস্থায়ীভাবে এটি স্থাপন করে। অথচ আলাপ চলে গেছে ভিন্ন দিকে, রাজু ভাস্কর্যের পাশে আরেকটি ভাস্কর্য স্থাপনের সৌন্দর্যহানির মধ্যে। আর এ বার্তার ভেতর দিয়ে ছাত্রদের মূল প্রতিবাদের ইস্যু আড়াল করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার যে অপসংস্কৃতি চলে আসছে, সেন্সরশিপের নামে মত প্রকাশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আছে, এসব নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মতামত নেই। উল্টো ওই শিক্ষার্থীরা এ ভাস্কর্য ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে কিংবা শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করতে চায় কি না তা নিয়ে নানা মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ক্ষমতার ধারকবাহকরা সবসময় ছাত্রদের প্রতিবাদকে ভয় পেয়েছেন। ক্ষমতা ভোগ করতে তারা ছাত্রদের চিরকাল রাজনীতি থেকে যেকোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছেন। যদি সৌন্দর্যহানিই হয়ে থাকে, তবে কর্তৃপক্ষ ভাস্কর্যটি অন্য জায়গায় স্থাপনের জন্য বলতে পারত। তা না করে ভাস্কর্যটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো! এর মধ্য দিয়ে এটা আবারও পরিষ্কার হলো, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের প্রতিবাদে ভয় পায়। আর সে ভয়ের কারণেই শেষ পর্যন্ত ভাস্কর্যটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো।

ভাস্কর্য স্থাপনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের একাংশের সভাপতি শিমুল কুম্ভকার গণমাধ্যমে বলেছেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের নির্দেশে রাতের অন্ধকারে ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়। এটি এখন আর আমাদের অবাক করে না। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র যেভাবে মত প্রকাশকে দমন করে আসছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সেই দমনপীড়নবিরোধী একটি প্রয়াসকে একই উপায়েই দমন করল বলে প্রমাণিত হয়।'

একটু পেছন ফিরে তাকাই। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত বিক্ষোভের দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তৈরি করেছিল স্মৃতিস্তম্ভ, প্রথম শহীদ মিনার। সেদিনও ছাত্রদের ওই প্রতিবাদী রূপ দেখে ভীত হয়ে মুসলিম লীগ সরকার একে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল। মাত্র তিন দিনের কম আয়ু ছিল বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনারের। ওই ঘটনার এত বছর পরে আবার প্রমাণিত হলো, ছাত্রদের প্রতিবাদী রূপ সবাই ভয় পায়। আমরা ইতিহাস থেকে পাঠ নিয়েছি- কোনো কিছুর ভয় দেখিয়ে অথবা নিশ্চিহ্ন করে প্রতিবাদকারীদের দাবায়ে রাখা যায় না, কখনও যাবেও না। ছাত্রারা সেদিনও বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষার জন্য প্রতিবাদ করেছে। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে ছাত্ররা সিনা টান করে আবারও রাজপথে দাঁড়িয়ে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এ বিদ্যাপীঠ যেমন জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে, তেমনি বাঙালি জীবনের এমন কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ নেই যাতে অংশ নেয়নি। শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটি আলোচনায় বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তিনি পেয়েছেন; তা হলো 'সামাজিকতা ও গণতান্ত্রিকতা। এর অভ্যন্তরে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা। ১৯৭১ সালের গণহত্যার প্রথম আক্রমণের কেন্দ্রগুলোর একটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে। যেন ফিনিক্স পাখির মতো আগুনে পুড়ে আবার জন্মগ্রহণ করেছে!'

এ ভূখণ্ডে রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, চেতনার নবজাগরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার অনেক ঘটনা ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে আছে। বিশ্বাস করি, পটভূমি যতই পরিবর্তিত হোক, যতই প্রতিক্রিয়াশীলতার ছায়া দীর্ঘ হোক সময়ের প্রয়োজনে এ বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের মতো রুখে দাঁড়াবে, বিক্ষোভে ফেটে পড়বে।

  • লেখক ও সাংবাদিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা