অলঙ্করন : প্রবা
১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো পরিবর্তনে মুজিব সফল না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।’ এ বক্তব্য ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনবদ্য অবদানের প্রামাণ্য দলিল। বঙ্গবন্ধু প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির আন্দোলনে অংশ নিয়ে। ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ পালনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পুলিশি নির্যাতনের পর গ্রেপ্তার হন তিনি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জেলে থাকার কারণে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নিতে না পারলেও আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল তারই নির্দেশনা ও পরামর্শে। এমনকি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানেও অংশ নেন তিনি।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দিতে পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য হিসেবেও সংসদে সোচ্চার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজবন্দি থাকলেও তিনি যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তখন ১৯৫১ সালের জানুয়ারিতে গভীর রাতে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগসহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষের নেতাদের পরপর দুদিন বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন প্রতিশ্রুতি ভেঙে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত আসে। তাই সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরক সময়ে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করতে না পারলেও এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নীতিনির্ধারকের ভূমিকা সঠিকভাবেই পালন করেছিলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের আগে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় বুঝতে পেরেছিলেন তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পরামর্শ দিতেন। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ফরিদপুর জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দিনটি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিলেন বলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। রাতে সিপাহিদের কাছ থেকে ঢাকায় ভীষণ গোলমালের খবর পান। জানতে পারেন কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। ফরিদপুরে ছাত্রছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’- এসব স্লোগান দিচ্ছিলেন।
ঢাকার খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু চিন্তিত হয়ে পড়েন। ২২ তারিখের খবরের কাগজ পড়ে বিস্তারিত জানতে পারেন তিনি। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা ছিল, ‘মাতৃভাষার আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলনে গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না, জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল হতে থাকে।’ পরবর্তী সময়ে মুক্তি পেয়ে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ভাষা আন্দোলনের সেই ধারাবাহিক জোয়ারের ফলেই পরবর্তী সময়ে স্বাধীন এক দেশের অভ্যুদয় ঘটাতে পেরেছিলেন।
গ্রন্থায়ন : আমিরুল আবেদিন