× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বিশ্লেষণ

তুরস্কের ধ্বংসস্তুপে হেঁটে বেড়িয়েছি

ওরহান পামুক

প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৪৬ পিএম

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

অলঙ্করন : জয়ন্ত জন

তুরস্ক-সিরিয়ায় দুর্যোগের ওই রাতে থেমে থেমে তুষারপাত হচ্ছিল। রাতের অন্ধকারে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বহুতল ভবনগুলো ধসে পড়ে। ভোরের আলো ভূকম্পনের বীভৎসতা দেখানোর জন্য অন্ধকারের চাদর টেনে নামাতে শুরু করে। ধ্বংসস্তূপে ক্যামেরা হাতে একজন। তার সামনে ইট-পাথরের স্তূপের নিচে একটা ১০-১২ বছর বয়সি মেয়ে নিস্তেজভাবে নড়াচড়া করছে। ক্যামেরায় এতটুকু গতি শনাক্ত করতে পেরেই লোকটি আশাহত হয়ে ওঠে। চিৎকার করে উদ্ধারকর্মীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। আমরা অনুভব করতে পারি, ওই মুহূর্তে লোকটির করণীয় কী তা পুরোপুরি স্থির করতে পারছে না। তার একার পক্ষে এই মেয়েটিকে কংক্রিটের স্তূপ থেকে টেনে বের করা সম্ভব নয়। দুজনই অসহায়; দুজনই নিশ্চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয় এ ধ্বংস উপত্যকায়।

দুর্যোগের সময় সাহায্য পাওয়াটা এত সহজ নয়। অন্তত ফোন হাতে লোকটি যত সহজে সাহায্য পাবে ভেবেছিল, তেমনটা হয় না। এমনকি ওই লোক শেষ পর্যন্ত সাহায্য পেয়েছিল কি না, সে খবরও আর জানতে পারিনি। রাষ্ট্রীয় সংস্থার জরিপ অনুসারে, এ ভূমিকম্পে প্রায় ৭ হাজার ভবন ধসে পড়েছে কিংবা নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জরিপের সংখ্যার তুলনায় বাস্তবিক সংখ্যা যে অনেক বেশি, তা সহজেই অনুমেয়। সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে সিরিয়াও। বিদ্যুৎসংযোগ বিঘ্নিত হওয়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রেও নানান প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাদেশিক শহরগুলোর পরিস্থিতি জানাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিগত ৮০ বছরে তুরস্কে এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেনি মানুষ। অবশ্য ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে চতুর্থ বড় ভূমিকম্পে ভয় পেলাম।

১৯৯৯-এর পর মারমারা ভূমিকম্পে ১৭ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শহর ইয়ালোভায় গিয়েছিলাম। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি ধ্বংসস্তূপের মাঝে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম। বুকের ভেতর চাপা যন্ত্রণা ও অপরাধবোধ জমেছিল সেদিন। ওই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে অন্তত কয়েকজনকে যদি উদ্ধার করতে পারতাম, তা হলেও কিছুটা স্বস্তি পেতামÑ এমন এক দায়িত্ববোধ আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু সেবার এ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো উপকারে না এসেই আমাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এবারও এমনটিই ঘটেছে। তুরস্কের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের চিত্র পুরোনো দুঃসহ স্মৃতি আবার জাগিয়ে তুলেছে। বারবার মনে হচ্ছ, দুর্যোগের কাছে মানুষ কতটা অসহায়!

ভূমিকম্পে তুরস্কের সড়ক ও এয়ারপোর্টগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বে ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্কের একাধিক বড় শহর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সংবাদচিত্র তুলে ধরতে বড় বড় সংবাদমাধ্যমকেও হিমশিম খেতে হয়েছে। ফলে উদ্ধারসাহায্য এবং ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতেও দুই দিন দেরি হয়েছে। মৃদু তুষারপাত এবং গর্জনরত বাতাস ধ্বংসস্তূপের নীরবতা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারছিল। এই নারকীয় পরিস্থিতিতে অপেক্ষা করতে করতে মানুষ একসময় বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। পরে তা ক্রোধে রূপ নেয়।

নারকীয় দুর্যোগই বলতে হবে। প্রথমে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের ৯ ঘণ্টা পরই ৭ দশমিক ৫ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প কাঁপিয়ে দেয় তুরস্ক-সিরিয়াকে। দ্বিতীয় ভূমকম্পনের  উৎপত্তিস্থল অবশ্য প্রথমটির ৬০ মাইল দূরবর্তী স্থানে। এমন প্রলয়কম্পনে আতঙ্কিত মানুষ স্বভাবতই পথে ছুটে বের হয়ে আসে। যারা পথে বের হয়ে আসতে পেরেছিল, তাদের সামনেও এক নারকীয় দৃশ্যই উন্মোচিত হয়। তারা হয়তো বেঁচে গিয়েছে, কিন্তু ধ্বংসস্তূপে তাদের আটকে থাকতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই বিধ্বস্ত নগরীতে চলার একটু পথ পেলেই মানুষ এগিয়েছে। তাদের বিভ্রান্ত চোখ আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়িয়েছে খাবার। আবহাওয়াও সেদিন তাদের বিরুদ্ধেই চলে গিয়েছিল। আন্দাজমাফিক কোনো এক জায়গায় হাত দিয়ে একের পর এক ইট সরিয়ে একটু উষ্ণতার সন্ধান করেছে অনেকেই। এই দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। অবশেষে নিজের আর্তি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই তারা মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করতে শুরু করল। কী ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা! চোখের সামনে উঁচু ইমারত ধুলোর পাহাড় হয়ে গেল!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ইতোমধ্যে নানান ছবি আপ্লোড করেছে। সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি তাদের মাধ্যমেও সেসব খবর আমরা পাচ্ছি। শুধু পোস্ট নয়, প্রতিটি ছবির সঙ্গে তারা একটি শিরোনাম সংযুক্ত করে দিচ্ছে। প্রযুক্তির বরাতে এতটুকু সুবিধা পেলেও বিশ্ববাসীর কাছে তারা বোধহয় নিজের অজান্তেই আরও দুটো বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। প্রথম বার্তাটি সহজাতভাবেই তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ, যার আগাম বার্তা পাওয়া কঠিন, সেই ভয়াবহতার কাছে মানুষের অসহায়ত্ব কত! দ্বিতীয় বার্তাটি দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মানুষের যন্ত্রণা ও আর্তির।

পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে দুর্যোগ আমাদের সামনে নিঃসঙ্গতা এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবণতা তুলে ধরে। তবে আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে আমরা দুর্যোগের সময়ে মানবপ্রবৃত্তির আরেকটি দিক দেখতে পাই। দুর্যোগগ্রস্ত মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরেফিরে সেই ভয়াবহতার প্রমাণ তুলে ধরার চেষ্টা করে। তাদের আর্তি সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার আকুতি থেকেই এমনটা করে। তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর যখনই সংবাদমাধ্যমকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন, তখনই অনেকে ক্যামেরা দেখে চিৎকার শুরু করেছে, ‘আমাদের ভিডিও করুন। আমাদের খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই। সরকার কি দেখছে না? উদ্ধারকর্মীরা কী করছে এতক্ষণ?’ এই প্রশ্নগুলো তাদের অসহায়ত্ব থেকে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ থেকে উৎসারিত। ভূমিকম্পের খবর পৌঁছার পরই যথাসাধ্য ত্রাণ ও সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থার অবনতির কারণে রাস্তাঘাটে গাড়ি আটকে রয়েছে। যে শহরে মানুষ বিপর্যয়ের কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে, সেই শহরের মানুষ অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর গুনতে নারাজ। মানসিক ভারে তারা এতটাই বিপর্যস্ত যে, এই সামান্য বিষয়টি তাদের মাথায় কাজ করছে না। দুর্যোগের দ্বিতীয় দিনে যখন ত্রাণ পৌঁছায়, তখন মানুষ হামলে পড়ে একটু খাবারের প্রত্যাশায়। এমনকি দুর্যোগের পরদিনই স্বেচ্ছায় কিছু ডাক্তার বিধ্বস্ত নগরীতে মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য পৌঁছেছেন। সব দুর্যোগের মতোই এখানেও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অনুপস্থিত। সংকট উত্তরণে পথ দেখানোর মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সেজন্য ভয়াবহ এ দুর্যোগের দুই দিন পর ত্রাণ এসে পৌঁছালেও অনেক মানুষের জন্য তা খুব দেরি হয়ে গেছে।


লেখক : নোবেলজয়ী সাহিত্যিক

 

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত, ভাষান্তর : আমিরুল আবেদিন

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা