হারুন হাবীব
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:০৯ এএম
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:১০ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
সরকারের সমালোচনা আছে, থাকা উচিতও; তা না হলে রাষ্ট্রশক্তি স্বেচ্ছাচারী হয়। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার শর্ত। সরকারকে তাই সমালোচনা শুনতে হয়, পছন্দ না হলেও, না শুনলে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়। যারা দীর্ঘকালীন সরকার পরিচালনা করেন, তাদের ক্ষেত্রে সমালোচনার আকার এবং প্রকার ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়। এর কারণ সরকারের সব কাজ সঠিক হয় না। সঠিকতার এই পরিমাপ ঘটে মানুষের রাজনীতি বিশ্বাসে, নিজস্ব মানদণ্ডে।
মানতেই হবে, আমাদের
মতো দেশে সরকারের সব কাজ সব ক্ষেত্রে স্বাধীন হয় না, বাইরের
অযৌক্তিক চাপ মানতে হয়। এর
পরও থাকে সরকারি বলয়ে
বিস্তর দুর্নীতি ও সুশাসনের অধঃপতন। ক্ষমতাসীনরাও আবার কখনও নিজেদের
এমন শক্তিমান ভাবতে শুরু করেন,
যা আত্মসংহারের পথকে প্রশস্ত করে।
এটিও বুঝতে তারা অক্ষম হন
যে, সরকারের রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষ বাদেও বৃহত্ত্বর
জনগোষ্ঠীর লক্ষ-কোটি ‘রাডার’
তাদের পর্যবেক্ষণ
করে। এই পর্যবেক্ষণ এমনই যে
তা এক সময় বৃহত্তর সামাজিক
প্রতিক্রিয়ার রূপান্তরিত হয়ে জাতীয়
রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
স্বভাবত একটি সরকারের কৃতিত্ব বা ব্যর্থতার
ওপর তার জনপ্রিয়তা নির্ণীত হয়।
সে পরীক্ষার চূড়ান্ত মানদণ্ড অবাধ ও নিরপেক্ষ
ভোট বা নির্বাচন, যেখানে
মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের মতের
প্রতিফলন ঘটাতে পারে। ভোট বেশি পেলে সরকার টিকে থাকে,
না পেলে বিদায় নেয়। এটিই
গণতান্ত্রিক রীতি। কিন্তু সরকারের
সমালোচনার সঙ্গে রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস ও মৌল ভিত্তির ওপর আঘাত হানার সুযোগ আছে কি?
জাতীয় রাজনীতির দুর্ভাগ্য যে, সম্ভবত
সে কাজটিই হচ্ছে। এন্তার আক্রমণ করা
হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও
জয়বাংলার মতো ভিত্তিসূচক বিষয়গুলোকে। কিছু মহলের
প্রচারযন্ত্র এসব ক্ষেত্রে এতটাই সরব যে,
তারা কোনোরকম রাখঢাক
না রেখেই যে বিষয়গুলো
পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালিকে শক্তি জুগিয়েছিল,
সেই ভিত্তিগুলোর ওপরই
তারা আঘাত হানছে! অতএব সতর্কতার প্রয়োজন আছে বৈকি।
বাংলাদেশ
৫১ বছর পেরিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের
রাজনৈতিক সংগঠক ও নেতৃবৃন্দ প্রায়
সবাই বিদায় নিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও একে একে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
জাতীয় জীবনের সব অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ আজ নতুনের হাতে, নতুনের
নেতৃত্বে। আমরা যারা ১৯৭১-এর জাতীয় রণাঙ্গনে যুক্ত হয়েছিলাম,
তাদের কাছে
এই পরিবর্তন আনন্দের,
গৌরবের। কিন্তু শংকাও আছে, যখন দেখি সরকারবিরোধিতার নামে ইতিহাসের মৌল
সূচকগুলোকে কলুষিত করার অভিযান চলে।
আমাদের
স্বদেশভূমি এমন
এক জনপদ,
যার পথচলা মসৃণ হয়নি।
স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় রাষ্ট্রের জনককে প্রায় সপরিবারে
হত্যা করা হয়েছে। ফলে এসেছে অভাবিত
দুর্যোগ; সে দুর্যোগ
গেছে রাজনীতির ওপর, সংস্কৃতির ওপর,
মুক্তিযুদ্ধ, জয়বাংলা
ও স্বাধীনতার ইতিহাসের
ওপর। এই পর্যায়ে বাংলাদেশ উল্টো পথে হেঁটেছে, লাখো
শহীদের রক্ত অপমানিত হয়েছে,
উগ্র সাম্প্রদায়িকতা নতুন করে গ্রাস করেছে। ত্রিশ লাখ
শহীদের আত্মত্যাগ
চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
অথচ ইতিহাস নতুন করে লেখা যায়
না, ঢেকেও রাখা যায় না। কারণ
ইতিহাসের যে শক্তি আছে
নিজের, তা
তার সত্যকে প্রতিরক্ষা
দেয়। ফলে জাতীয় স্বাধীনতার সত্যগুলো পুনরায় সগৌরবে
ফিরে এসেছে। সেই সত্যশক্তি ইতিহাসের
ঘাতকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। বঙ্গবন্ধু,
মুক্তিযুদ্ধ ও জয়বাংলা আবারও স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। সংকট ও সীমাবদ্ধতা,
ভুল বা ব্যর্থতা কম ছিল বা আছে ভাববার কারণ নেই। কিন্তু
নামের খোলসে নয়,
ইতিহাসের সত্যকে পুঁজি করে
বাংলাদেশ সত্যিকারের বাংলাদেশ হয়েছে।
এ এক বড় প্রাপ্তি। কিন্তু এতেই কি আত্মতুষ্টির কারণ আছে?
আমার মনে হয়Ñ নেই।
কারণ বাংলাদেশ এমনই এক রাষ্ট্র যার আদর্শিক প্রতিপক্ষ, দুর্ভাগ্যক্রমে
আজও সক্রিয়। অন্যদিকে সক্রিয় অসৎ, চতুর
পরগাছা মানুষের দল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তিনি বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিকর সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সফল জনবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে জন্ম দিয়েছিলেন স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রের। সেই জনবিদ্রোহ একদিকে শোষণ-বঞ্চনাপিষ্ট স্বৈরতন্ত্রী পাকিস্তান ভেঙেছে, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ভুললে চলবে না, স্বাধীনতা লাভের মাত্র ১০ মাসের মাথায় সংবিধান অনুযায়ী গোটা বিশ্ব মুসলিমপ্রধান বিশ্ব জনপদে বাংলাদেশই হয়ে ওঠে একমাত্র আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু সেই জাতীয় উজ্জীবনকেই আঘাত করা হয়েছে ১৯৭৫—এর রক্তাক্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন ধর্ম ব্যক্তিজীবনের বড় অবলম্বন; কিন্তু রাষ্ট্র ধর্ম-বর্ণ, ছোট-বড় নির্বিশেষ সবার সমান অধিকার সংরক্ষণ করে। এটিও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন—ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ধর্মের আত্মাকেই কেবল খর্ব করে না, রাষ্ট্র এবং মনুষ্যত্বকেও সংকুচিত করে। তাই একজন খাঁটি মুসলমান হয়েও তিনি ধর্মীয় রাজনীতি সমর্থনের কারণ খুঁজে পাননি। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ এই ঘোষণা বাস্তবায়নের পথে তিনি যখন মনোনিবেশ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে আরেক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন,ঠিক তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়।
স্মরণ করা উচিত,
১৯৭০-এর দশকের পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মানসে যে দেশপ্রেম, তা ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ
নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে উজ্জীবিত
করার; আগে যা সম্ভব হয়নি,
তাই সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর
হাতে। সেই উজ্জীবনকেই
আঘাত করা হয়েছে। সরকারি পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে পরীক্ষিত
স্বাধীনতাবিরোধীদের বসানো হয়েছে। অপসারণ করা হয়েছে
মুক্তিযোদ্ধাদের। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সরকার
নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের
ঘাতকদের পরিকল্পিত ভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
মোট কথা,
বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যের
ওপর পুনর্জাগরিত এই অপশক্তির
আঘাত চলতে থাকে প্রায়
দুই যুগ ধরে। ফলে বিকাশ ঘটে একটি লুটেরা 'লুম্পেন
শ্রেণির' যার ধারাবাহিক আগ্রাসনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পথভ্রষ্ট হয়েছে,
বিভাজিত হয়েছে, নতুন
প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রতারিত হয়েছে, জাতীয়
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে খণ্ডিত
করা হয়েছে। বাঙালি যখনই অসাম্প্রদায়িক
জাতীয় গৌরব নিয়ে সামনে
এগিয়েছে, যুক্তি ও
বিজ্ঞানমনস্কতার পথে হেঁটেছে, তখনই ‘ধর্ম গেল’
বলে একশ্রেণির মানুষ চেঁচিয়েছে।
এই শোরগোলে সাধারণ
ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী বিভ্রান্ত হয়েছে। অথচ
পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে,
বাংলার গণমানুষ কখনো
ধর্মচ্যুত হয়নি, বরং তাদের ধর্মপ্রাণ সব পরিস্থিতিতে ছিল
পরীক্ষিত।
অনেক ভাঙাগড়া, ব্যর্থতার পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্জন কম কিছু নয়। দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়েছে, সামাজিক সূচকে এগিয়েছে, যোগাযোগ ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের বিস্ময়কর অর্জন ঘটেছে। যদিও সহনশীল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের ইতি টানা আজও সম্ভব হয়নি— যা এক বড় দুর্ভাগ্য। তবে এতকিছুর পরেও রাষ্ট্রের বিপদ কি কমেছে? কমেনি। বরং অর্ধশতক পরেও, রাষ্ট্রশক্তি দেখুক বা না দেখুক, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তি নতুন করে পুনর্জাগরিত হয়েছে। এ যে কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনবে তা সময় বলে দেবে।
ইতিহাসের
সত্য অনুধাবন জরুরি যে, ১৯৭১
সালের মুক্তিযুদ্ধ,
যা সকল ধর্ম-বর্ণের
মানুষকে একাত্ম করে জাতিকে স্বাধীনতার
ময়দানে নামিয়েছিল, তা
ছিল এই জনপদের মানুষের এক নবজাগৃতি।
যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ ধরেই সে
জাগৃতি ঘটেছিল, তথাপি
তাকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল বাংলার
আবহমান সাংস্কৃতিক শক্তিÑ যার ভিত্তিমূলে
ছিলেন লালন, রবীন্দ্রনাথ,
নজরুল, জীবনানন্দ
ও সুকান্ত।
কাজেই প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপের, প্রয়োজন সার্থক রেনেসারঁ, নবজাগৃতির; যা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, মুক্ত;উদার ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনের পথে দেশকে এগিয়ে নেবে। সুতরাং রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি বাঙালির সাংস্কৃতিক লড়াইকে এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধ, জয়বাংলা ও বঙ্গবন্ধুকে শুধু কণ্ঠে ধারণ করলেই চলবে না, তাকে ধারণ করতে হবে আত্মায়। জাগিয়ে তুলতে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ভুললে চলবে না— বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিপক্ষরা নানা কৌশলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেমেছে। তারা সমাজকে নতুন করে ধর্মান্ধ করছে।
স্মরণ করা
সংগত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানি ঔপনিবেসিক
শাসকদের হটিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ ছিল
না, ছিল একই সঙ্গে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এই ভূখণ্ডের অধিকারহীন মানুষের
মুক্তির যুদ্ধ। কিন্তু সে স্বপ্নপূরণ
বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাল্টা
আঘাত এসেছে। সাতচল্লিশের দৈত্য একাত্তরের
চেতনাকে পর্যুদস্ত করেছে, কূপমণ্ডুকতার পুনরাভিযান ঘটানো
হয়েছে, ধর্মব্যবসায়ীদের
নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
স্বাধীনতা সব নাগরিকের,
সব দল মত ও রাজনৈতিক বিশ্বসের মানুষের। মতের অমিল বাইরের,
অন্তরে বাংলাদেশ। স্বাধীনতাকে মানার প্রধানতম শর্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সমহিমায় মান্য করা, মুক্তিযুদ্ধকে
তার অবিকৃত ইতিহাসে বরণ করা।
এবং আরও প্রয়োজন জাতির জনককে গণ্ডিবদ্ধ
না করে, সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালি মহানায়ককে
সর্বজনীন করা।
তাঁর আদর্শকে মর্মে উপলব্ধি ও বেগবান করা। অতএব
আজকের প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়
শক্তির সম্মিলন। এ লড়াই বাংলাদেশকে রাখার, মুক্তিযুদ্ধ
ও জয় বাংলাকে রাখার;
এ লড়াই কোনো
রাজনৈতিক দলের একার নয়, এ লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থি প্রতিটি নাগরিকের।