আলম শাইন
প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:৩৬ এএম
ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের
দেশ হলেও শিল্পোন্নত দেশের
তালিকায় এখনও স্থান করে
নিতে সক্ষম হয়নি। অথচ
শিল্পদূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান
বেশ নাজুক। স্বাধীনতার
পর মাত্র ৩১৩টি শিল্প-কারখানা
নিয়ে শিল্পখাতের যাত্রা
শুরু করে বাংলাদেশ। বর্তমানে
এই সংখ্যা প্রায় ৪৬
হাজার ১১০টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ
একান্ন বছরে প্রায় দেড়শ
গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে আমাদের
শিল্প-কারখানা। স্বাধীনতালগ্নে আমাদের প্রধান শিল্পের
তালিকায় ছিল পাট, সুতা, চিনি, চা, বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি। তখনও চামড়া কিংবা
ওষুধশিল্পের প্রসার ঘটার সম্ভাবনা
দেখা যায়নি। এমনকি
বস্ত্রশিল্পের যাত্রা আশির দশকে
শুরু হলেও আজকের মতো
তখন এতটা পরিচিতি পায়নি। অথচ বস্ত্রশিল্প বর্তমানে
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের
অন্যতম মাধ্যম এবং দেশীয়
বাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি
রপ্তানি বাজারেও পণ্যের তালিকা
বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে
দেশে বৃহৎ শিল্প-কারখানার সংখ্যা
তিন হাজারের ওপরে। যা
এখন আমাদের শিল্পখাতের মেরুদণ্ড
বলা যায়। তবে
এ কারণে আমাদের পরিবেশগত
সমস্যার মুখোমুখিও হতে
হয়েছে মারাত্মকভাবে নিয়মনীতি
না মানা কিংবা দায়িত্বশীলতার
পরিচয় না দিতে পারার
কারণে।
দেশের ভারী শিল্প-কারখানা
সাধারণত রাজধানী এবং নদীতীরবর্তী
অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। এ
ছাড়াও দেশের বিভাগীয় শহর
অথবা গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়
ভারী শিল্প-কারখানা নজরে
পড়ে। এতে শিল্প-কারখানায়
ব্যবহৃত বর্জ্যে শহরদূষণের পাশাপাশি
নদী-খাল
দূষণের শিকার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। শুধু তাই-ই নয়, মাটি, পানি, আবহাওয়া
ও পরিবেশের প্রধান উপাদানগুলো
শিল্পদূষণের মারাত্মক শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে কারখানার
বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলার
কারণে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, জৈব
সংক্রামক পদার্থ ও ক্ষতিকর
গ্যাসীয় পদার্থের মিশ্রণ ঘটছে। এর ফলে নদী-খালের
পানি বিষাক্ত হয়ে যেমন
বিবর্ণ হচ্ছে, তেমনি জলজ
উদ্ভিদসহ মাছ, পোকামাকড় ও
অণুজীব বাসস্থান হারাচ্ছে। এ
ছাড়াও এ পানি ব্যবহারে
মানুষ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন
হচ্ছেন। বিশেষ করে
পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে
অনেকে অকালে মৃত্যুবরণও করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
২০০৭ সালে এক প্রতিবেদনে
উল্লেখ করেছে, অনিরাপদ পানি
সরবরাহের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে
৪ বিলিয়ন মানুষ ডায়রিয়ায়
আক্রান্ত হচ্ছে এবং ১.৮
বিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের
শিল্প-কারখানার মাধ্যমেই শিল্পের
দূষণ ঘটছে। তার
মধ্যে বেশি দূষণ হচ্ছে
দক্ষিণ ঢাকায়। শ্যামপুর
শিল্প এলাকায় কাপড় রঙ
করার কারখানাগুলো থেকে
প্রচুর পরিমাণে তেল, গ্রিজ এবং
অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয় এমন
ধরনের রাসায়নিক পদার্থ জলাশয়গুলোকে
দূষিত করছে। এ
ছাড়াও অন্যান্য ভারী শিল্প-কারখানাগুলোর
সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না
থাকার কারণে শহরের পরিবেশ
মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে।
এর আগে রাজধানীর
শিল্পদূষণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি
মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল হাজারীবাগে
ট্যানারি শিল্প। ওখানে
ছোট-বড়, মাঝারি
মিলিয়ে প্রায় ১৯৪টি ট্যানারি
ছিল ২০২১ সাল অবধি, যার
প্রতিটিই থাকত রাত-দিন কর্মব্যস্ততায়। কাঁচা চামড়া এবং
ট্যানারির বর্জ্যে এখানকার লোকজনদের
হা-পিত্যেশ
অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল বহু
বছর ধরেই। হাজারীবাগের
পরিবেশ বিপর্যয়ের হিসাব-নিকাশের
খতিয়ান নতুন করে উপস্থাপন
করার মতো তেমন কিছু
নেই। কারণ যা
ক্ষতি হওয়ার গত কয়েক
দশক ধরেই তা হয়েছিল। তারপরও জানাতে হচ্ছে
পরিবেশবিদদের কিছু মতামত। তাদের
মতে,
ট্যানারি থেকে প্রতিদিন ২২
হাজার ঘনমিটার ক্রোমিয়াম, সালফার, অ্যামোনিয়াসহ ক্ষতিকর
নানা বর্জ্য এলাকা বিষিয়ে
তুলছিল। এ ছাড়াও দূষণকারী
রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই
ট্যানারির বিষাক্ত পানি সরাসরি
বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলা হতো। এ দূষিত পানির
প্রাত্যহিক পরিমাণ ১৫ হাজার
ঘনমিটার। এর ফলে
নদীর পানি বিবর্ণ হয়ে
দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। তাতে
শুধু হাজারীবাগই নয়, বুড়িগঙ্গার
আশপাশের মানুষও ট্যানারি কারখানার
দূষণের শিকার হয়েছিল।
জানা যায়, ট্যানারির বর্জ্য, চামড়া, চর্বি, গরু-ছাগল-মহিষের
হাড়,
দাঁত, পুড়িয়ে পোল্ট্রি ফিডসহ
নানা জিনিসপত্র তৈরি
করা হতো। এ
কাজটি প্রতিদিনই করা
হতো। পোড়ানো মুহূর্তে
আশপাশে থাকা তখন দারুণ
কষ্ট হতো মানুষের। শুধু
তাই-ই
নয়,
ওই মুহূর্তে বাসাবাড়িতে থাকাটাও
কঠিনতর হয়ে পড়ত। ওই
দূষিত বায়ু গ্রহণ করে
বৃদ্ধ ও শিশুরা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত
রোগে আক্রান্ত হয়েছিল মারাত্মকভাবে। হাজারীবাগে ট্যানারিগুলো প্রতিদিন
প্রায় ২১ হাজার ৬০০
ঘনমিটার তরল বর্জ্য সরাসরি
বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলত। যার
ফলে বুড়িগঙ্গা ব্যাপক
দূষণের কবলে পড়েছিল। অন্যদিকে
পশুর চামড়ার উচ্ছিষ্ট অংশ
বেড়িবাঁধের আশপাশে ফেলা রাখা
হতো। এতে জনসাধারণের
দুর্ভোগের পাশাপাশি পরিবেশের মারাত্মক
বিপর্যয় ঘটেছে তখন।
বিষয়টি অসহনীয় পর্যায়ে
চলে যাওয়ায় আদালত ১৪-১৫
বছর আগেই হাজারীবাগ থেকে
ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ
দিয়েছিলেন। পরে কয়েক
দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১
সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে
ট্যানারি সরানোর নির্দেশ দেন
আদালত। যে দূষণ
ইতোমধ্যে হয়েছে, তাতে হাজারীবাগ
তথা বুড়িগঙ্গার ক্ষয়ক্ষতি
ফিরিয়ে আনা যাবে না
সহজে। এ সমস্যার সমাধানের
জন্যই মূলত শিল্প মন্ত্রণালয়
২০০৩ সালে চামড়াশিল্প নগর
প্রকল্প হাতে নেয়। ১
হাজার ৭৯ কোটি টাকার
এই প্রকল্পের অধীনে
সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯
একর জমি অধিগ্রহণ করে
১৫৪টি ট্যানারিকে প্লট
প্রদান করে।
এর মধ্যে অনেকগুলো কারখানা উৎপাদন উপযোগীও করা হয়েছে। কিছু ট্যানারি হাজারীবাগের মতো আবাসিক এলাকা থেকে এখনও সরিয়ে নেওয়া হয়নি। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও মালিকরা তাদের ট্যানারি স্থানান্তর করতে গড়িমসি করছেন। বর্তমানে সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীতে ১৪১টি ট্যানারি রয়েছে। সেখানে কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে, ট্যানারিগুলো থেকে প্রত্যহ ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য বেরুচ্ছে। ২৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা থাকলেও কঠিন বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা নেই। সেখানে যথাযথ মান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হোক। না হলে হেমায়েতপুরের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে আরেক হাজারীবাগের সৃষ্টি হবে। এতে রাজধানী বিষমুক্ত হলেও হেমায়েতপুর ঝুঁকিতে পড়বে। বিকশিত প্রযুক্তির যুগে এমনটি তো কাম্য হতে পারে না।