পাভেল পার্থ
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫২ পিএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
দেশের দীর্ঘতম নদীপ্রণালির
অন্যতম সুরমা আজ ভালো নেই। উজানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ এবং ভাটিতে নদীর
প্রবাহে নানামুখী বাধা, জকিগঞ্জের অমলসীদে সুরমার প্রবেশমুখে পলি পরে বিশাল চর জেগেছে।
সিলেট নগরীর আশপাশে সুরমা প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যে চাপা পড়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল
থেকে জুলাই দীর্ঘ তিন মাস সিলেট নগরের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ এলাকা পাহাড়ি ঢল ও বন্যার
পানিতে তলিয়েছিল। অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর প্লাস্টিক দূষণের কারণেই সিলেটে তৈরি হয়েছিল
নিদারুণ জলাবদ্ধতা। সুরমা খননের দাবি দীর্ঘদিনের। ১৮ কিলোমিটার নদী আপাতত খনন হচ্ছে।
সিলেট নগরীর বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে এই খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড
(পাউবো)। প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ সুরমার কুচাই থেকে লামাকাজী পর্যন্ত সুরমা
নদীর খননকাজের পরিকল্পনা হয়েছে।
২১ জানুয়ারি ২০২৩ সিলেট সদরের
মোঘলগাঁও ইউনিয়নের চানপুর খেয়াঘাটে সুরমা নদী খননকাজের উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ড. একে আব্দুল মোমেন। কিন্তু সুরমা খননে বড় প্রতিবন্ধকতা প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য।
ড্রেজার ও খননযন্ত্রে বারবার প্লাস্টিক ও পলিথিন আটকে যায় এবং যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়।
খননকাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্লাস্টিক ও
পলিথিনের জন্য কাজ করা যাচ্ছে না। যতক্ষণ ড্রেজারে খনন হয়, তার চেয়ে বেশি সময় যায় ড্রেজার
পরিষ্কার করতে। সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নদীতে বিপুল
পরিমাণ পলিথিনের স্তর জমায় ২০ মিনিট পরপর মেশিন বন্ধ রেখে পরিষ্কার করে কাজ করতে হচ্ছে।
এতে সময়মতো কাজ শেষ করা কঠিন হবে (সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩)।
প্লাস্টিক-পলিথিনের জন্য মূলত
দায়ী কে? কেন আমাদের নদী-জলাভূমিগুলো আজ প্লাস্টিক-পলিথিনের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে? আজ
প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণের কারণে সুরমা খনন করা যাচ্ছে না। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী
সব নদীর ক্ষেত্রেই প্লাস্টিক-পলিথিন বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার
কারণেই আজ আমরা করপোরেট পণ্য-মানসিকতায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়েছি, প্লাস্টিক-পলিথিনের
বিশাল স্তূপ তৈরি করছি নির্বিকারে। আর এই প্লাস্টিক-পলিথিন নদীগুলোকে জখম করছে, নদীপথ
আটকে দিচ্ছে, নদীর খননকাজ প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
নদীকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই
বাংলাদেশকে চিন্তা করা যায় না। কিন্তু তাই ঘটে চলেছে। কখনও ফারাক্কা কখনও টিপাইমুখ
নদীর ওপর উন্নয়নের ছুরি চলেছে সব কালেই। উজান থেকে ভাটিতে বয়ে চলা নদীর জটিল গণিতকে
ফালি ফালি করে কাটা হয়েছে। দেশের একটি নদীও আর শরীর-মনে সুস্থ নেই। অনেক নদীই হারিয়েছে
আত্মীয়-পরিজনদের। নদীমাতৃক দেশের নদীকে বিবেচনায় রেখে কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি।
নদীকে বিবেচনা করা হয়েছে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের ভাগাড় হিসেবে। যখন যে যেভাবে পারছে
দেশের নদীগুলোকে খুন-জখম করছে। রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত একটি নদী-খুনেরও ন্যায়বিচার নিশ্চিত
করেনি।
দেশের নদীগুলো আজ ক্ষত-বিক্ষত।
পণ্য বিশ্বায়িত দুনিয়ার নয়া উদারবাদী মনস্তত্ত্ব নদীকে দেখে পণ্যবোঝাই যান চলাচলের
রাস্তা আর কারখানার বর্জ্য-ভাগাড় হিসেবে। এক বোতল কোমল পানীয়ের বোতল বা নুডলসের খালি
প্যাকেট নদীর বুকে কতটুকু যন্ত্রণা আর আঘাত জমা হয় তার হিসাব আমরা কখনই করিনি। প্লাস্টিকের
বিরোধী আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ‘ব্রেক ফ্রি ফ্রম প্লাস্টিক’ করপোরেট প্লাস্টিক দূষণবিষয়ক
তাদের তৃতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর। দশাসই সব খাদ্য-পানীয়-প্রসাধন
কোম্পানির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। পৃথিবীর ৫৫টি দেশ থেকে প্রায়
১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৪৯৪টি প্লাস্টিক নমুনা সংগ্রহ করেন। দেখা গেছে,
এগুলো প্রায় সবই কোনো না কোনো কোম্পানির পণ্যের বোতল, মোড়ক ও ধারক।
পলিথিন এক জ্যান্ত পুঁজিবাদী
পাপ। নয়া উদারবাদী বাণিজ্য সামাজ্যের দুঃসহ ক্ষত হিসেবে পলিথিন এ সভ্যতাকে গলা টিপে
ধরছে বারবার। পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাতকরণ
ও ব্যবহার শুরু হয়। পলিথিন গলে না, মেশে না, পচে না। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের
৬ (ক) (সংশোধিত ২০০২) ধারা অনুযায়ী ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে এবং একই সালের
১ মার্চ বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০০২)-এর
১৫ (১) অনুচ্ছেদের ৪ (ক) ধারায় পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের জন্য অপরাধীদের
সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান আছে। মাঝেমধ্যে এ আইন
মেনে ভ্রাম্যমাণ আদালত কিছু জরিমানা আর অভিযান চালালেও পলিথিন থামছে না। নদীকে প্লাস্টিক-পলিথিনমুক্ত
রাখতে অবশ্যই এসবের উৎপাদন, ব্যবহার ও বিক্রির ওপর আইনত নিষেধাজ্ঞা জরুরি। তাহলে সুরমা
বাঁচবে, বাঁচবে দেশের নদীভূগোল।
উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ডের পাটকাই পাহাড়ের গভীর অরণ্য থেকে ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু নিয়ে বরাকের জন্ম। মণিপুরের লোগতাক হ্রদ থেকেও জল পেয়েছে বরাক। মণিপুর রাজ্যের সেনাপতি জেলার লাইলাই গ্রাম থেকে তামেলং হয়ে চুরাচাঁদপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসামের বরাক ও কাছাড় উপত্যকায় প্রবেশ করেছে বরাক। টিপাইমুখ অঞ্চল থেকে উচ্চ অববাহিকায় প্রবাহিত হয়েছে নোনে, নুংবাহ্ এবং তুইভাই নদী। নোনে ও নুংবাহ্ মণিপুরের পাহাড় থেকে এবং মিয়ানমারের পাহাড় থেকে জন্ম নিয়েছে তুইভাই। টিপাইমুখ থেকে নিম্ন অববাহিকায় প্রবাহিত হয়ে বরাকে মিলিত হয়েছে নারায়ণছড়া, বড়বেকড়া, ছোট বেকড়া, কাংরিংছড়া, জিরি, চিরি, সোনাই, রূকণি, মধুরা, জাটিঙ্গা, ঘাঘরা, কাটাখাল, ধলেম্বরী, লঙ্গাই, সিংলার মতো নদীগুলো। এ ছাড়াও বরাক নদীতে মিলিত হয়েছে ৫-১০ ফুট প্রশস্ত অসংখ্য পাহাড়ি ঝিরি ও ছড়া। বরাক উপত্যকার কাছাড় ও হাইলাকান্দি জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বরাক নদী আসামের করিমগঞ্জ জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদ এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত হয়েছে। উজানে বাঁধ এবং ভাটিতে প্লাস্টিক-পলিথিন সুরমার ওপর সব খবরদারি ও জখম বন্ধ হোক। প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যে আমরাই সুরমাকে নিপীড়িত করেছি, এই আঘাত সামলে সুরমা খননের যাবতীয় চ্যালেঞ্জ এখন আমাদেরকেই নিতে হবে।
লেখক ও গবেষক