আলাপন
লোপা মমতাজ
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:২০ পিএম
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:৩৭ পিএম
বাগানে কাজ করছেন রংগলাল খেরুয়ার। ছবি : প্রবা
রংগলাল খেরুয়ার পূর্বপুরুষ সেই অনেক কাল আগে ভাগ্য অন্বেষণে কেরালা থেকে আসেন এই বঙ্গদেশে। খেরুয়ার চা বাগানের মালী। থাকেন শ্রীমঙ্গলে।
খুব সাদামাটা জীবন তার। চা-বাগানগুলোতে রংগলালের মতো অনেকেই বংশপরম্পরায় আছেন প্রায় ২০০ বছর ধরে। নিজেদের জমি মনে করেই বসবাস করছেন চা-বাগানে; কিন্তু তারা জমির মালিকানা পাননি। তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মের স্রোতে। রংগলালের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে তাদের জীবনযাত্রার কিছু চিত্র। এরই চুম্বক অংশ উপস্থাপিত হলো।
কি নাম আপনার?
রংগলাল খেরুয়ার। আমার স্ত্রীর নাম বাসকী খেরুয়ার।
ছেলেমেয়ে কয়জন?
দুই মেয়ে এক ছেলে। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, ভালো আছে। আমার ছোট মেয়েটা ম্যাট্রিক পাস করেছে। তারপর আর পড়াইতে পারি নাই পয়সার অভাবে। লেখাপড়ার অনেক খরচ। এক সঙ্গে সবাইকে লেখাপড়ায় দিলে পোষাইতে পারব না। মেয়েটার ব্রেন ভালো ছিল, তবুও পড়াইতে পারি নাই। এখন ঘরেই থাকে। মায়ের কাজে সাহায্য করে। আমার ছেলেটাও মেট্রিক পাস করেছে। এখন বাগানে কাজ করে মায়ের বদলি হিসেবে। আমার বউও আগে বাগানেই কাজ করত।
এখানে এলেন কীভাবে?
সেটা তো অনেক কাল আগের কথা। আমার বাবার বাবা-মা, তারও মা-বাবা ছিলেন কেরালায়। ব্রিটিশ আমলে সেখান থেকে তাদের এই সিলেট চা বাগানে আনা হলো চা তোলার কাজ করতে। আমি পাকিস্তান আমলে হই। ’৭১-এ যুদ্ধ লাগল। সেই সময় আমরা ইন্ডিয়া চলে গেলাম। দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন আবার ফিরে এলাম এখানে। কারণ এইটাই তো আমার দেশ। আমার তো এইখানেই জন্ম হইছে। সেই তখন থেকে আমরাও চা-বাগানে কাজ করছি।
কী কাজ করেন?
আমি চা-বাগানে মালীর কাজ করি। বাসা চা-বাগানের ভেতরে। গাছ কাটি, পাতা কুড়াই, ঝাড়ু দিই, গাছের যত্ন করি।
কী কী সুবিধা পান?
চার-পাঁচ মাস ধরে বেতন পাই ১০ হাজার। তবে কাজে ভুল হলে এক থেকে দুইদিনের টাকা কাটা যায়। আবার পূজার সময় যে বোনাস থাকে, সেখান থেকেও কাটা যায় যদি কোনো কাজে ভুল হয়।
আপনার পূর্বপুরুষ তো কেরালার। সেই অঞ্চল সম্পর্কে কিছু জানেন?
যারা আসে তারা বলেছে ওখানের পরিবেশ নাকি অনেক ভালো, অনেক সুন্দর। ইচ্ছা হয় ঘুরে আসি, কিন্তু ভাগ্যের দোষে যেতে পারি না।
রেশনে কী কী পান?
তিন কেজি আটা। এইটুকুই আর কিছু না।
দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় কী কী থাকে?
সব দিন তো ভালো-মন্দ খেতে পাই না। কোনো দিন ডাল, কোনো দিন সবজি, কোনো দিন মাছ পাইলে মাছ। আবার কোনো কোনো দিন আলু, চানাচুর, পিঁয়াজু দিয়ে চা পাতার ভর্তা খাই।
কাজের পর সময় কীভাবে কাটান?
কিছু করি না। এভাবেই থাকি। মা-বাবার কথা মনে হয়। মন খারাপ হয়।
চা-বাগানে বাড়ির আশপাশে অনেকেই শাকসবজি চাষ করে, আপনিও করেন?
অনেকেই করে। আমি যে জায়গাতে আছি সেখানে করা যায় না। পানিতে ডুবে যায়।
কী কী উৎসব হয় চা-বাগানে?
মনে করেন দুর্গাপূজা, দোলপূজা, সংক্রান্তি আছে, সরস্বতী পূজা, কালিপূজাও আছে।
একটা মন খারাপের গল্প বলেন।
এই জীবনটাই তো মন খারাপের। আলাদা করে কি বলব। ভালো খেতে পারি না, ভালো পড়তে পারি না। সরকারি ওষুধে কি হয় বলেন। বড় অসুখ হলে ওষুধ পাই না। চা-বাগানের স্কুলে প্রাইমারি পর্যন্ত ফ্রি। তারপরের ক্লাসে টাকা দিয়ে পড়াইতে হয়। নিজে লেখাপড়া করতে পারি নাই, কিন্তু ছেলেমেয়েদের জন্য চেয়েছিলাম। টাকার অভাবে বড় ক্লাসে ওদের লেখাপড়া করাইতে পারলাম না। চা-বাগানের জমিতে থাকি, নিজের থাকার একটা জায়গা নাই। এই তো। আর কি বলব।
এবার ভালো লাগার কোনো গল্প বলেন।
আপনাদের মতো মানুষেরা আসেন, আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করেন- এইটাই ভালো লাগা।