× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জাতীয় মুক্তি ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৪ পিএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না, তিনি তখন সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর অভিযুক্ত আসামি। কিন্তু অভ্যুত্থানের সময় তাঁর ভাবমূর্তি সর্বক্ষণই উপস্থিত ছিল। বস্তুত অভ্যুত্থানের লক্ষ্যগুলোর ভেতর একটি ছিল আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তি। মামলাতে অন্যরাও অভিযুক্ত ছিলেন; তাদের ওপর, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহী সদস্যদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছিল এবং মামলার সময় সেসব কাহিনি বের হয়ে আসায় পূর্ববঙ্গের মানুষ পাকিস্তানি রাষ্ট্রের বাঙালি-বিদ্বেষী ঔপনিবেশিক চরিত্র সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হয়ে উঠছিল; অভিযুক্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের তো অবশ্যই, শেখ মুজিবের প্রাণদণ্ডাদেশ হয় কি-না, তা নিয়ে বিশেষভাবেই উদ্বিগ্ন ছিল মানুষ। স্থূলবুদ্ধির তৎকালীন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ধারণাই করতে পারেনি যে প্রকাশ্য বিচারে এই মামলার পরিণতি পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ওপর কত বড় আঘাত হিসেবে আসতে পারে। জনমনে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে মামলার মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন শেখ মুজিব, এবং তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই মামলার সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করা হয়েছে এবং তাঁর অপরাধ তিনি বাঙালির পক্ষে উঠে দাঁড়িয়েছেন।

শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে অনেক গবেষণা ও গ্রন্থ রচনা হয়েছে; সেখানে এবং তাঁর নিজের লেখা আত্মজৈবনিক রচনাগুলোতেও বাঙালির জাতীয় মুক্তির ব্যাপারে তাঁর উপলব্ধি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। অভ্যুত্থানের পরিণতিতে তিনি ‘বঙ্গবন্ধুউপাধি পেয়েছেন। এক জীবনে তিনি জনপ্রিয়তার যে শীর্ষে গিয়ে পৌঁছেছিলেন, অন্য কোনো বাঙালি নেতার পক্ষে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুউপাধি টিকে থাকবে, যেমন ভিন্নতর এক পরিপ্রেক্ষিতে চিত্তরঞ্জন দাশের ‘দেশবন্ধুউপাধি আজও টিকে আছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন চেয়েছিলেন বাঙালির রাজনীতিকে আগ্রাসী ভারতীয় রাজনীতি থেকে আলাদা করবেন; কিছুটা এগিয়েও ছিলেন; কিন্তু ১৯২৫ সালে তাঁর অকালমৃত্যুতে বাংলার রাজনীতির ওই স্বতন্ত্র ধারাটি আর টিকে থাকতে পারেনি; কংগ্রেসের ও মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্রমবর্ধমান স্রোতের বিপুলতার ভেতর হারিয়ে গেছে। হতাশাজনক সেই ঘটনার পরিণতি ঘটেছে ১৯৪৭ সালের মর্মান্তিক দেশভাগে।

দেশভাগের পরপরই বোঝা যাচ্ছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মুক্তি আসেনি। মুক্তির জন্য মীমাংসা প্রয়োজন ছিল দুটি জরুরি প্রশ্নের; একটি জাতির, অন্যটি শ্রেণির। এই দুটি প্রশ্নে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সরব ছিল; কিন্তু দুই বুর্জোয়া দলের রাজনীতির দাপটে প্রশ্ন দুটি তাদের গুরুত্ব ধরে রাখতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের মানুষেরা যে নতুন একটি ঔপনিবেশিক শাসনের কব্জায় পড়ে গেছেÑ এ ব্যাপারে অত্যন্ত সরব হয়ে উঠেছিলেন দুজনÑ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মওলানার বয়স বেশি, অভিজ্ঞতাও অধিক, তিনি ছিলেন সবার আগে; মুজিব এসেছেন পরে। প্রথমে তাঁরা এক সঙ্গেই ছিলেন, কিন্তু পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, যেটা অবধারিত ছিল। কারণ মওলানা ভাসানী জাতি ও শ্রেণি, এই উভয় প্রশ্নের মীমাংসার দাবি তুলেছিলেন, শেখ মুজিবের দৃষ্টি ছিল মূলত জাতি প্রশ্নের মীমাংসার ওপরই। মেহনতি মানুষদের দুঃখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতেন, সে দুঃখে সর্বদাই তিনি কাতর থাকতেন। বাংলার মানুষের বঞ্চনা ও বেদনার কথা তিনি যেভাবে বলতেন, তাঁর বয়সি অন্য কোনো জাতীয়তাবাদী নেতা সেভাবে বলেননি। বাঙালির দুঃখ ঘোচানোর জন্য তিনি প্রয়োজন মনে করেছিলেন পাঞ্জাবি শাসনের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ। মওলানাও তাই মনে করতেন, পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার কথা তিনিই প্রকাশ্যে সর্বপ্রথম তুলেছেন; কিন্তু জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে তিনি যুক্ত করতে চেয়েছিলেন মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে। শেখ মুজিবের অবস্থান ছিল ভিন্ন। উনিশ শ একাত্তরের ৭ মার্চের সেই অবিস্মরণীয় বক্তৃতাতে তিনি ঠিকই বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তাঁর বিবেচনায় পূর্ববঙ্গের জন্য দুটোই ছিল আবশ্যক, তবে প্রথমে প্রয়োজন ছিল স্বাধীনতার। সেই লক্ষ্যেই তিনি লড়ছিলেন।

পাকিস্তানি শাসকরা মুক্তির দাবির চেয়ে স্বাধীনতার দাবিকেই অধিক বিপজ্জনক মনে করত। কারণ মুক্তি জিনিসটা দূরবর্তী, সুদূরপরাহতও বলা চলে; কবে আসবে জানা যায় না, আসবে কি-নাÑ তাই-বা কে জানে এবং মুক্তির সংগ্রামে কেবল পাঞ্জাবি বুর্জোয়ারা নয়, উঠতি বাঙালি বুর্জোয়ারাও যে বাধা দেবে এটাও তো ছিল সুনিশ্চিত। শাসকরা তাই মুক্তির সংগ্রামকে নয়, স্বাধীনতার সংগ্রামকেই ভয় করত। ৭ মার্চে তাদের শঙ্কা ছিল মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন কি-না তা নিয়ে। মুজিবের ওপর চাপ ছিল, বিশেষ করে ছাত্রদের; পাকিস্তানি শাসকরা সেটা জানত। মুজিব যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন নাÑ এতে তাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছিল। তারা ভেবেছিল আপাতত তো বিপদ কাটল, পরে দেখা যাবে কী হয়। তা ছাড়া মুজিব তো আলোচনার পথ বন্ধ করে দেননি, তিনি শর্ত দিয়েছেন কয়েকটি।

সেনাবাহিনীর মধ্যে উগ্রপন্থিদের সঙ্গে মধ্যপন্থিরাও ছিল; যারা সামরিক পদ্ধতিতে শেষ রক্ষা হবে না বলে মনে করত এবং রাজনৈতিক সমাধানের কথা ভাবত। তবে আইয়ুব খান তো ঘোষণাই দিয়ে রেখেছিলেন যে ছয় দফা দেওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অস্ত্রের ভাষাতেই তিনি কথা বলবেন। তার চেলা মোনায়েম খাঁও ওই পথেরই পথিক হতে চেয়েছিলেন। আপাত বিবেচনায় ছয় দফাতে অবশ্য ভয়ঙ্কর কিছু ছিল না; দফাগুলোর ভিত্তিতে তো ছিল লাহোর প্রস্তাবের আদি রূপরেখা, যেখানে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে একাধিক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক একদিন লাহোরে গিয়ে ওই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন, যার ওপর ভর করে অসংশোধনীয় রূপে এককেন্দ্রিক একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, যে রাষ্ট্র আদি প্রস্তাবের একেবারে প্রাথমিক শর্তটিই নাকচ করে দিতে চেয়েছিল। ২৬ বছর পরে বাংলারই অপর এক নেতা ওই লাহোরে গিয়েই ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করে আদি প্রস্তাবটিকেই পুনরুজ্জীবিত করার দাবি জানিয়েছিলেন।

পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা প্রমাদ গুনেছিল; ছয় দফাতে তারা এককেন্দ্রিক পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ দেখতে পেয়েছিল। পাকিস্তান যে ভাঙবে সেটা অনিবার্যই ছিল; কিন্তু আপসরফা করে একটি ফেডারেল কাঠামো দাঁড় করিয়ে আরও কিছুদিন হয়তো তাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো এবং তাতে ক্ষয়ক্ষতিটা কম ঘটত। কিন্তু নব্য ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকরা অতটা ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের পাকিস্তান এককেন্দ্রিক এবং সে পাকিস্তানে পূর্ব শোষিত হবে পশ্চিমের দ্বারা। ছয় দফা সেই ব্যবস্থায় আঘাত করেছে। পাকিস্তানের শাসকরা মুজিবকে তাই এক নম্বর শত্রু বিবেচনা করে কেবল কারাবন্দি করেই নিশ্চিন্ত হয়নি, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলাতে জড়িয়ে প্রাণনাশ ঘটানো যায় কি-না, দেখতে চেয়েছিল। সেই পদক্ষেপে অবশ্য সম্পূর্ণ উল্টো ফল ফলেছে। বাংলাজুড়ে স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতার দাবিই উঠেছে।

আইয়ুব বলেছিলেন যে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের কোনো উপায়ই নেই। কারণ ওটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে এক সময়ের ‘লড়কে লেঙ্গেপাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের চেয়েও অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠতে পারে এবং বলপ্রয়োগে দমন করতে গেলে তার প্রবলতা যে বাড়বে বৈ কমবে না, এই জ্ঞান রাষ্ট্রশাসকদের ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের নতিস্বীকার করতে হলো। নতি নয়, পরাজয়ই। আগরতলা মামলা প্রত্যাহৃত হলো, শেখ মুজিবসহ মামলার সব অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেলেন এবং শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বেরিয়ে এলেন। আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছিলেন; মুক্ত না হলে তিনি যোগ দেবেন নাÑ মুজিব এই শর্ত দিলেন। আইয়ুব খান সেই শর্ত মেনে নিতে এবং গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ‘রাষ্ট্রদ্রোহীশেখ মুজিবের সঙ্গে করমর্দনে বাধ্য হলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে এটি আইয়ুবের প্রথম পরাজয়। দ্বিতীয় ও শেষ পরাজয়টি ঘটল যখন তিনি বাধ্য হলেন পদত্যাগে। পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করবেন না, অর্থাৎ নির্বাচনে দাঁড়াবেন না, এ রকমের ঘোষণায় কাজ হয়নি। তাঁকে প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে। 


- শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা