× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

একুশে বইমেলা, রাজনীতি ও নাগরিক জীবনের সংকট

মামুনুর রশীদ

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:০৯ এএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

পয়লা ফেব্রুয়ারি প্রতি বছরের মতো অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে এবারও বিপুল পরিমাণ বই এসেছে কিন্তু চার মাস ধরে আশঙ্কা করা হয়েছিল, কাগজের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে খুব অল্পসংখ্যক বই হয়তো মেলায় আসবে করোনা-দুর্যোগে প্রকাশনা শিল্পের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে, সেই সঙ্গে কাগজের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছিল কিন্তু দেখা গেলো, প্রকাশকরা নানান ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নতুন বই আনতে শুরু করেছেন ধারণা করা যায়, হয়তো শেষ পর্যন্ত সংখ্যার দিক থেকে অনেক বই- আসবে তবে গুণগত মানের দিক থেকে এগুলো কতটা পাঠকচিত্ত আলোড়িত করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে প্রকাশনা শিল্পে এখন একটি নতুন প্রবণতা দেখা দিয়েছে, বিত্তবান লেখকরা নিজেদের অর্থায়নে বই প্রকাশ করে থাকেন গুণগত মানের দিক থেকে সেসব বই যথার্থই মানসম্মত হয় না কিন্তু প্রকাশকরা লাভবান হয়ে যান বিশেষ করে প্রবাসী লেখকরা প্রকাশকদের দিয়ে এসব বই বাজারে এনে থাকেন সংখ্যার দিক থেকে তা একেবারে নগণ্য আবার দেখা যায়, সরকার প্রতি বছর কিছু বই কেনে রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাব খাটিয়ে এই বইগুলো বিক্রি হলে প্রকাশক লেখকদের লগ্নি অনেকটাই উঠে আসে

প্রতিবারের মতো এবারও প্রত্যাশা করা যায় বইমেলায় প্রচুর ভিড় হবে কিন্তু ভিড় অনুযায়ী বই বিক্রি কখনই হয় না অমর একুশে বইমেলার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা সমস্যা হচ্ছে, বইমেলায়ই শুধু কিছু বই বেচাকেনা হয় সারা বছর প্রকাশকরা যে দোকান খুলে বসে থাকেন, তাতে তেমন বই বিক্রি হয় না যদিও ঢাকা, চট্টগ্রাম সিলেটে আন্তর্জাতিক মানের কয়েকটি বইয়ের দোকান রয়েছে, যেখানে দেশ-বিদেশের নানান ধরনের বই পাওয়া যায় পৃথিবীর বড় বড় শহরে একটা বইয়ের বাজার থাকে কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, ঢাকার বাংলাবাজারে পাইকারি একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও সাধারণ পাঠকের জন্য কোনো বইয়ের বাজার নেই কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো একটা বাজার আছে এবং বাজারটি কতকগুলো নামকরা কলেজের সঙ্গে যুক্ত প্রতিদিন ওই বাজারটি সরগরম থাকে বিপুলসংখ্যক মানুষ সারা দেশ থেকে এসে বই সংগ্রহ করে

রকম একটি বাজার গড়ে উঠেছিল শাহবাগের আজিজ মার্কেট কেন্দ্র করে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাজারটি বুটিকের দোকানের কাছে বিক্রি হতে থাকে অবশ্য এখনও কিছু কিছু দোকান অবশিষ্ট রয়েছে আজিজ মার্কেটের একটা বড় সুবিধা ছিল, জায়গাটি শহরের কেন্দ্রস্থলে এবং যোগাযোগের দিক থেকেও খুব সুবিধাজনক আজিজ মার্কেটে লেখকদেরও একটা আড্ডা গড়ে উঠেছিল কবি, নতুন চলচ্চিত্রকার, মিডিয়াকর্মী, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিকরা নতুন ভাবনা নিয়ে ওখানে নিয়মিত আড্ডায় মেতে উঠতেন জায়গাটি তাদের ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল, দ্বিতীয় ঠিকানাটি ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে ছবির হাটে ছবির হাটও ছিল শিল্পীদের একটা নিয়মিত দেখাশোনা, কথা বলার জায়গা সেটাও এক অজ্ঞাত কারণে বন্ধই করে দেওয়া হলো জায়গাটিতে শিল্পীরা ছবি আকঁতেন এবং ছবি আঁকার পাশাপাশি একটা বাজারও গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর বড় বড় শহরে চিত্রকরদের জন্য রকম ব্যবস্থা প্রায় সর্বত্রই থাকে সেখানে একটু-আধটু নেশাও করে থাকেন অনেকে কিন্তু রাষ্ট্র এসব মেধাবী শিল্পীকে নানাভাবে প্রশ্রয় দেয়, কারণ যেকোনো সভ্যতায় এমনটি অন্যায় কিছু নয়

আজকের তরুণদের মধ্যে ডিজিটাল আসক্তি বেড়েছে, কিন্তু পাঠাভ্যাস ক্রমাগতভাবে কমে আসছে আজ ৩০ বছরের যুবক-যুবতীদের ওপর জরিপ চালালে দেখা যাবে, শতকরা দুই ভাগও একটি পুরো কবিতা মুখস্থ বলতে পারবে না যেকোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা বইয়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে গুগলের আশ্রয় নেয় সামান্য অঙ্কের সমাধান করতে গিয়ে ক্যালকুলেটরের আশ্রয় নেয় আসলে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে শিশুকালেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই পাঠ্যবই যথার্থ আনন্দের সঙ্গে পড়ার সুযোগ তৈরি হয় না শিক্ষকরা শুধু পড়ালেখার বিষয়টিকে পরীক্ষা পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন এবং ছাত্রদের কোচিংয়ের দিকে ধাবিত করেন ফলে ওই শিশুকাল থেকেই সে জেনে এসেছে, লেখাপড়া হচ্ছে পরীক্ষা পাসের জন্য, জীবনাচরণের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই

জ্ঞানচর্চার জন্য যে ছোটবেলা থেকেই অপাঠ্য বই পড়া প্রয়োজন, তা সে পারে না ফলে তার জ্ঞানের দিগন্ত ছোট হতে হতে একেবারে শূন্যের কোঠায় পৌঁছায় এর ওপর আছে পড়ার প্রচুর চাপ পাঠ্যবই বহন করতে করতে তার মেরুদণ্ডটা বাঁকা হতে হতে একসময় ভেতর থেকেই ভেঙে যায় ফলে চরিত্র গঠনের জন্য যে মেরুদণ্ড প্রয়োজন তা আর তৈরি হয় না শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব মনীষী বড় বড় অবদান রেখে গেছেন, তাদের কথাও শিশুদের কাছে পৌঁছায় না যতটুকু পৌঁছায় তা- অসত্য এবং ভুলে ভরা রাষ্ট্র নাগরিকদের চরিত্র গঠনের জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী লগ্নি করে থাকে লগ্নিটা হয় সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিক্ষকদের মাধ্যমে সেখানেই শুরু হয় সংকট শিক্ষক কর্মকর্তারা চাকরি করতে আসেন এই নিশ্চিন্ত চাকরি তাকে জ্ঞানচর্চা থেকে বিরত করে ফেলে আগে যারা শিক্ষক হতেন বা স্কুল পরিদর্শক থাকতেন, তারা ছিলেন বিদ্যাসাগরের অনুসারী শিক্ষার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের কাজও করতেন ফলে তাদের মেরুদণ্ড ছিল শক্ত

সাম্প্রতিককালে একটা ভালো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোণেও একেবারে বেসরকারিভাবে বইমেলা শুরু হয়েছে বইমেলাগুলো মানুষের পাঠাভ্যাস করার আন্দোলনের অংশ ৫০০ গ্রামীণ পাঠাগারের একটি সম্মেলন হয়ে গেল টাঙ্গাইলের অর্জুনা গ্রামে ৫০০ গ্রামীণ পাঠাগারের প্রতিনিধিরা তাদের বুক স্টল নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন একেবারেই পৃষ্ঠপোষকতাহীন ওই বই মেলা বেশ কয়েকদিন চলেছে এটি অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক ঘটনা এমনি প্রেরণার সৃষ্টি হোক সারা দেশে, এটাই আমাদের কামনা আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশের রাজনীতি শুধু ক্ষমতা দখলের জন্য নাগরিক জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে তাদের ভাবনা নেই শিক্ষা সংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভয়ানকভাবে অবহেলিত প্রতিদিনের মতো মানুষের জীবনের সময় কমিয়ে দিচ্ছে ১০ মিনিটের পথ যেতে যেখানে দুই ঘণ্টা লেগে যায়, সেখানে কারও পক্ষে সময় অঙ্গীকার ঠিক রাখা সম্ভব নয় সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্তকে ছিন্নমূল করে দিচ্ছে কিন্তু জ্ঞানচর্চার অভাবে এই মধ্যবিত্ত নতুন কোনো পথও বের করতে পারছে না আবারও জাপানের উদাহরণ দিতে হয় ১৮৬৮ সালে জাপান পেশিশক্তির বিপরীতে মেইজি সংস্কার করেছিল সেই সংস্কারের ফলে শতাব্দী শেষ না হতেই দেশটি শতভাগ শিক্ষিত করে তুলেছে জনগণকে সেই শিক্ষা ছিল যথার্থ শিক্ষা আদর্শ, প্রযুক্তি শুদ্ধাচার মিলিয়ে যে কার্যকর শিক্ষা পদ্ধতি তারা অনুসরণ করেছে, তাতে জাপান খুব দ্রুতই একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে জায়গা করে নিয়েছে বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও জাপান প্রযুক্তিতে বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে

আজ বাংলাদেশেও যখন আমরা উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর কোনো কাজ করতে যাই, তখন জাপানের সাহায্য নিতে হয় এসবের মূলে রয়েছে যথার্থ শিক্ষা এই যথার্থ শিক্ষার ব্যবস্থাটি আমাদের রাষ্ট্র খুব অবহেলার সঙ্গে করে থাকে হাজার হাজার পিএইচডি এবং উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি সমাজের কোনো কাজেই লাগেন না অসংখ্য সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে কোনো শিল্প উদ্যোক্তা নয়, সৃজনশীল কোনো উদ্ভাবক নয়; অর্থ উপার্জনের সহজ পথ হচ্ছে রাজনীতি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, রাজনীতির সূচনা হচ্ছে বিদ্যালয় থেকে রাজনীতি পথ হারাচ্ছে এবং গঠনমূলক রাজনীতির পরিবেশ ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে অভিযোগ নতুন নয় এর বিরূপ ফল হয়ে দাঁড়াচ্ছে বহুমুখী স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই অর্থলাভের বিদ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে বিষয়টি যে খুব খারাপ, তা শিক্ষাব্যবস্থা তাদের শেখায়নি এই গোড়ার বিষয়টি ঠিক না হলে, পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না বইমেলা কবে কখন সার্থক হবে, জানি না তবে সবকিছু ঠিকঠাক করতে না পারলে একসময় দেশটাই মুখ থুবড়ে পড়বে

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব  কলামিস্ট

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা