ফজিলাতুন নেসা শাপলা
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:০২ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
২০২৩-এ ঘোষিত হলো নতুন শিক্ষাক্রম। এবারের শিক্ষাক্রমে আনা হয়েছে আমূল পরিবর্তন। একদিকে যেমন প্রথাগত পরীক্ষা কমিয়ে আনা হয়েছে, বড় অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। অর্থাৎ পাঠ্যবই মুখস্থ নয়, শিক্ষার্থীরা তার চারপাশ থেকে কি শিখছে— সেই শিখনফলের ওপর গুরুত্ব দেওয়াটাই এবারের শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য। গুরুত্ব বিবেচনা করে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা হলো নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি। পদক্ষেপটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ব্যক্তিচরিত্র ও সমাজ গঠনের জন্য নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণা বলছে, ‘উদার গণতন্ত্র তখনই বিকশিত হতে পারে যখন সমাজের নাগরিকবৃন্দ কিছু নৈতিক ও নাগরিক মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিচরিত্রে কিছু বিশেষ গুণাবলি ধারণ করে (আলটফ অ্যান্ড বারকোয়িটজ, ২০০৬)।’ নৈতিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আর যে বিষয়টি জড়িত তা হলো আমাদের মূল্যবোধ। মূল্যবোধ গড়ে ওঠে বিশেষ কিছু গুণাবলির সমন্বয়ে। যেমন— সততা, বিশ্বস্ততা, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি। তাই ব্যক্তির চরিত্র গঠন, তার সুষ্ঠু সামাজিক বিকাশ এবং মূল্যবোধ তৈরি করতে চাইলে নৈতিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করতেই হবে। অন্যদিকে শিশুর মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা তৈরিতে শুধু পরিবার নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা হলে এবং দীর্ঘদিন ধরে সে বিষয়গুলো প্রায়োগিকভাবে চর্চা করতে পারলে তবেই শিশু-কিশোরদের চিন্তা, অনুভূতি, বিশ্বাস ইত্যাদি পরিবর্তন করা সম্ভব।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে নৈতিক শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়নি। যুদ্ধপরবর্তী প্রজন্ম নানাভাবে নৈতিক
শিক্ষা পেলেও মূল শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয়টি সংযুক্ত না থাকায় দুই-তিন প্রজন্ম ধরে অভিন্নভাবে এসব গুণ শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ ছিল না। যার ফলে একদিকে যেমন মূল্যবোধের অবনতি ঘটেছে এবং সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক পরিবর্তনও বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতার বড় কারণ। গোটা বিশ্ব প্রযুক্তির দখলে চলে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সমাজে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলছে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে সামাজিক জটিলতাও বৃদ্ধি পেয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে টেলিভিশনসহ অন্য গণমাধ্যমে এবং আকাশ সংস্কৃতির কারণে এমন কিছু দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠছে যেগুলোর নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি। এ পথ বন্ধ করা সহজ নয়, তবে নিজেরা সচেতন ও দায়িত্বশীল হলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অবকাশ অনেকটাই থাকবে। এজন্য
পরিবার-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সমাজের বিভিন্ন অংশকে
অধিকতর সজাগ হতে হবে। সতর্ক
থাকতে হবে। পূর্ববর্তী নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার গুরুত্ব এখন আগের মতো নেই। আজকাল
শিক্ষার্থীদের মন, আচরণ ও মূল্যবোধে এসেছে বড় পরিবর্তন, যেগুলো মেনে নিতে বাবা-মা হিমশিম খাচ্ছেন।
পরিবর্তিত এই সময়কে বিবেচনা করে শিক্ষাক্রমের যে আধুনিকীকরণ করা হলো, এর ফল কী? উদাহরণ হিসেবে এবারের তৃতীয় শ্রেণির ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে নৈতিকতার অংশটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ‘আব্বা-আম্মার কথা শোনা, সহপাঠীদের সাথে ভালো ব্যবহার, সালাম বিনিময়, মেহমানদের সাথে ভালো ব্যবহার, মানুষের সেবা, জীবে দয়া, সত্য কথা বলা। ‘হিন্দু ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে আছে, নম্রতা, ভদ্রতা ও অগ্রাধিকার, সততা ও সত্যবাদিতা, স্বাস্থ্যরক্ষা ও আসন, দেশপ্রেম, মন্দির ও তীর্থক্ষেত্র। ‘খৃষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ের পাঠ্যসূচি, ‘মানুষ ও তার উৎস, ঈশ্বর, ত্রিব্যক্তি ঈশ্বর, শয়তানের পরাজয় ও শাস্তি, পবিত্র বাইবেল, ঈশ্বরের দশ আজ্ঞা,পাপ, মুক্তিদাতার জন্ম, পবিত্র আত্মার দান ও ফল, খৃষ্টমণ্ডলী, সাক্রামেন্ত, নোয়া, সেবার আদর্শ মাদার তেরেজা, মৃত্যু ও পুনরুত্থান, বিশ্বাসমন্ত্র, ভূমিকম্প এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খৃষ্টান শহীদ। ‘বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইয়ে নৈতিক শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘গৃহশীল’ বিষয়টি। এখানে চারটি ধর্মই হয়তো নানাভাবে একই কথা বলছে কিন্তু এই বিষয়গুলো একমুখী ও অভিন্ন নৈতিক শিক্ষাদান পদ্ধতিকে নির্দেশ না করার ফলে সব শিক্ষার্থীর একই বিষয়, একই রকমভাবে অনুশীলন করার সুযোগ নেই। ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার’ নৈতিকতার অংশটির অনুশীলনে রয়েছে— (১) সঠিক উত্তরের পাশে টিকচিহ্ণ দাও, (২) শূন্যস্থান পূরণ কর, (৩) বাম পাশের কথাগুলোর সঙ্গে ডান পাশের কথাগুলোর মিল কর এবং (৪) সংক্ষেপে উত্তর দাও। সংক্ষিপ্ত প্রশ্নপর্বে (গ) নম্বর প্রশ্নটি করা হয়েছেÑ ‘সালাম বিনিময়ের বাক্যটি আরবীতে লেখ’। এমনটি শিশু শিক্ষার্থীদের জীবনে কী কাজে লাগবে তা বোধগম্য নয়।
অপর একটি প্রশ্নে বলা হয়েছে, ‘আব্বা-আম্মাকে খুশী রেখে কী লাভ?’ তৃতীয়
শ্রেণির একটি শিশুর জন্য এটি একটি জটিল প্রশ্ন। প্রকৃত অর্থে
সততা, ক্ষমা, উদারতা, জীবে দয়া করা, অন্যকে সেবা করা মুখস্থ করার কোনো বিষয় নয়। এগুলো
ব্যক্তিজীবনে অনুশীলন করে অর্জন করাটা আবশ্যক। শিক্ষার্থী এককভাবে, যৌথভাবে বা দলগতভাবে যত বেশি চর্চা করবে তত বেশি সে এসব গুণ অর্জন করবে। চরিত্র গঠন বা মূল্যবোধ তৈরির জন্য এ গুণাবলিকে সামাজিক দক্ষতা বলা হয়ে থাকে। আর ব্যক্তি কোনো বিষয় যত বেশি চর্চা করবে তত বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে। কাজেই
পরিবার নয়, একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অভিন্নভাবে সব শিশু-কিশোরকে দীর্ঘদিন ধরে এসব সামাজিক দক্ষতার অনুশীলন করাতে সক্ষম।
পরিবর্তিত এই সময়ে নৈতিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন একমুখী ও অভিন্ন পাঠ্যক্রম। এর পাঠপরিকল্পনা হবে প্রায়োগিক, পাশাপাশি নিয়মিত অনুশীলন করার জন্য চাই বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা উপকরণ।শিক্ষার্থী একই বিষয় অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের নৈতিক চরিত্র গঠন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু নৈতিক শিক্ষাকে ধর্মশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে প্রতিটি ধর্মবই পৃথকভাবে শেখানো হলে, শিশু-কিশোররা স্ব স্ব ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের ভালো এবং শিক্ষণীয় বিষয়গুলো থেকে বঞ্চিত হবে। পাশাপাশি একমুখী শিক্ষা, অভিন্ন মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলার যে লক্ষ্য, তা বহুলাংশে ব্যাহত হবে। শ্রেণিকক্ষে ধর্মশিক্ষার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষাকে সংযুক্ত করে দেওয়া যে খুবই জরুরি এবং আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও সময়োপযোগী, সেটা ভাবার সময় উপস্থিত।
লেখক : কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়