ড. মোহীত উল আলম
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:৩৩ এএম
অলঙ্করন : জয়ন্ত জন
১৯৫২ থেকে ২০২৩, সময়ের ব্যবধানে ৭১ বছর। বায়ান্ন আমাদের ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায়। বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হলো, বাংলা মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃ্তিও পেল। বায়ান্নর চেতনায় একাত্তরের সড়ক নির্মাণ এবং স্বাধীনতা অর্জন। এর মধ্যে আরও কত কিছু ঘটে গেল। স্বাধীন দেশ ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে আমাদের অর্জন কম নয়। কিন্তু সবচেয়ে অনুতাপের বিষয় হলো, আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় নিশ্চয়ই বলা যায়, ভাষার লড়াই শেষ হয়নি। ফেব্রুয়ারি এলেই অমর একুশ সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় তো বটেই, সামাজিক বিভিন্ন পর্যায়েও নানারকম উদ্যোগ-আয়োজন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশের বইমেলা তো আছেই (এই বইমেলা এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়ে বিপরীত প্রান্তের উদ্যানের অনেকাংশ জুড়ে চলে প্রায় মাসব্যাপী) রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরেও চলে নানারকম অনুষ্ঠান। ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক আমাদের সব আবেগ যেন বছরওয়ারি ফেব্রুয়ারিতেই জেগে ওঠে, আবার ফেব্রুয়ারি অন্তে মিইয়েও যায়।
মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ভাষাশহীদদের রক্ত বিসর্জন,
আত্মদান বৃথা যায়নি। একুশ আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপৃত।কিন্তু
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায়,
আমরা কি আনুষ্ঠানিকতা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কিছু অবকাঠামো গড়ে এবং কাগজে-পত্রে
সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকবো?
বায়ান্ন থেকে একাত্তর এবং একাত্তর থেকে দু হাজার তেইশ—এই অধ্যায়গুলো
যদি আমরা ভিন্ন ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের ব্যাপক অর্জন দৃশ্যমান হয়ে উঠবে কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় যেটুকু করার সেটুকু করতে পারি নি তাও দৃষ্টির বাইরে থাকবে না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে না পারার বিষয়টি শেষোক্তরই অংশ। এই না পারাকে পারায় পরিণত করা মোটেও দুরূহ কোনো বিষয় নয়। আমরা অনেক কিছুতেই খুব সহজে আত্নতৃপ্ত হয়ে যাই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ভুলে যাই ইতিহাসের দায়। ইতিহাসের দায় ভুলে আর যা-ই হোক জাতি
হিসেবে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছতে পারবো না। ফেব্রুয়ারি এলেই মাতৃভাষা কিংবা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা সরকারি-বেসরকারি
পর্যায়ে নানা উদ্যোগ-আয়োজনে
যেভাবে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাই,
মাতৃভাষা বাংলার সর্বস্তরে প্রচলনের ক্ষেত্রে কি নিজ নিজ জায়গা থেকে বিশেষ করে সরকার সেই দায়িত্বপালন করতে পেরেছে?
প্রশ্নটির উত্তর প্রীতিকর নয়।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হচ্ছে ভাবগাম্ভীর্যের আবরণে। আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলনের এবং বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্তির দীর্ঘদিন পর গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বসংস্থার তরফে ভাষা আন্দোলন ও আমাদের মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদাদান গৌরবের। আমরাও একুশ স্মরণে,
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদাদানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ-আয়োজন
কম নেইনি। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের পাশাপাশি আরও অনেক কাজই হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমরা স্বাধীনতা-উত্তর
একান্ন বছর অতিক্রান্তে কতটা সক্ষম হয়েছি?
বাংলাভাষা সর্বস্তরে প্রচলন করা যায়নি কেন?
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আদালতসহ অনেক ক্ষেত্রেই এখনও প্রচলিত নয়। অথচ এটিই তো ছিল আমাদের মূল চাওয়া। এই যে না পারা কিংবা ব্যর্থতা এটি একুশের অর্থাৎ মাতৃভাষার প্রতি অমর্যাদা বলেই মনে করি। একুশের চেতনার একটি মৌলিক বাস্তবায়নযোগ্য দাবি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা।
বাংলা ভাষার মর্যাদা-অমর্যাদার
প্রশ্নে কথা বললে আরও অনেক কিছুই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। সামগ্রিক হালচাল দেখে এটা বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই,
মাতৃভাষার ব্যবহার নিয়ে আমরা বিরাট একটা আত্মপ্রবঞ্চনাকে নিশ্চিত প্রত্যয় হিসেবে ধরে নিয়েছি। আমরা দেখেছি,
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বাস্তবে সম্ভব হয়নি,
কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি তো বটেইÑ
ফেব্রুয়ারি এলেই এ ব্যাপারটা নিয়ে একটা জিদ ধরে থাকি। বাংলাদেশে কোনো দিন ইংরেজি,
আরবি,
উর্দু বা হিন্দি ভাষা বাংলা ভাষার স্থান দখল করে নেবে। সেটা কোনোদিন হবে না,
হওয়ারও নয়। বাংলাদেশের এটা বিরাট সুবিধা,
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এবং হিরণ পয়েন্ট থেকে জাফলং কোথাও বাংলা ভাষার বিকল্প অন্য ভাষা ব্যবহার করতে হয় না। যদি এই সামান্য বিষয়টুকু নিয়ে আলোচনা করি,
তাহলেও তো আলোচনার টেবিলে অংশগ্রহণকারীরা সমস্বরে প্রশ্ন করতেই পারেন,
বাংলা সর্বস্তরে চালু না হওয়ার কারণ কী?
এই প্রশ্ন যে ওঠেনি তা-ও তো নয়। উঠেছে এবং এখনও উঠছে। কিন্তু আলোচনা-পর্যালোচনায়ই
থেমে যায় উদ্যোগ-আয়োজন। বাংলা সর্বস্তরে চালু হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তিসংগতভাবে বাধার দেয়াল দাঁড় করানো দুরূহ। অভাব শুধু সদিচ্ছার,
একাগ্রতার এবং সবচেয়ে বড় অসংগতি লক্ষ করা যায় রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সরকারের দৃঢ় মনোভাবের ক্ষেত্রে। যতদূর জানি,
এ পর্যন্তকার প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলেই এ নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। বিশেষ করে একুশের পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে কিংবা একুশকেন্দ্রিক অন্যসব আয়োজনে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পরিলক্ষিত হওয়ায় বাংলা ভাষার ওপর আন্তর্জাতিকতার মাত্রা বেড়ে গেছে। ফলে তার মৌল রূপ থেকে কৌম রূপের দিকে প্রসারিত হওয়ার সুযোগ আরও বেড়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ঐতিহাসিক পটভূমির কারণে বাংলা ভাষার কৌম রূপের প্রসারণের ওপর প্রচ্ছন্ন একটা ছায়ার মতো প্রভাব বিস্তারিত হতে দেখতে পাচ্ছি,
যা হয়তো বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের বিপক্ষে কাজ করছে। বিষয়টা যতটা না চাক্ষুষ,
তার চেয়ে বেশি আধিপত্যমূলক একটি দৃষ্টিভঙ্গি।
একুশের চেতনার সাম্প্রতিক বিচার-ব্যখ্যার
যে পরিণাম দেখা যাচ্ছে তা শুধু দুঃখজনকই নয়,
বাঙালি চৈতন্যের পক্ষে মর্মবেদনারও বটে। আমরা যদি পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের দৃশ্যমান আমাদের জাতিসত্তার আবেগ-মনোভাব
বিচার করি তাহলে দুঃখবোধটা আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। বায়ান্নর সেই দিনগুলোতে বাঙালি তরুণ তথা ছাত্রসমাজ আশ্চর্য এক সমাজচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে মুক্তিযুদ্ধ পর্ব পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে। কিন্তু এরপর?
এরপর অনেক কিছুই আর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এগুয়নি। যদি তা-ই হতো তাহলে
আজও ভাষার লড়াই চলতো না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেককিছু করলাম,
কাগজে-কলমে
অনেক সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাস এ পর্যন্তই;
যদি অবস্থা এমন হয় তাহলে সুফলের আশা করা দুরাশা বৈ কিছু নয়। মাতৃভাষা বাংলার সর্বস্তরে প্রচলন নিয়ে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার একান্ন বছর পরও কথা বলতে হয় যা বিস্ময়কর।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা কোণঠাসা এটা ভাবা যায়!
আমরা জানি,
ভাষা কোনো যন্ত্র নয়,
মন্ত্রও নয়,
ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির জীবন উপাদান। ভাষার ভেতর চিন্তা-চেতনা-ইতিহাস-ঐতিহ্য-দৃষ্টিভঙ্গি
সবকিছুই সংরক্ষিত থাকে। অস্বীকার করার উপায় কী স্বেচ্ছাকৃত পরাধীনতা অনেক বেশি ভয়ংকর। মাতৃভাষার অমর্যাদা করে যে অগ্রসর হওয়া যায় না সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধে তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। মাতৃভাষার অমর্যাদা মানসিক দৈন্যের প্রতিফলন। আমাদের বিকাশ,
সমৃদ্ধি,
সম্মান সব কিছুই তো নির্ভর করছে ঐক্যের ওপর এবং ঐক্য আসবে না যদি বাংলা ভাষাকে সবার ভাষা করতে পারি। সে পথে প্রধান অন্তরায়টা আবারও বলি,
রাজনৈতিক। আমাদের অভাব আছে অনেক কিছুর। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা অংশের এখনও অভাব আছে দেশপ্রেমের। জিজ্ঞাসার প্রসার গণতান্ত্রিক সমাজে অত্যন্ত আবশ্যক। পরিবারে,
প্রতিষ্ঠানে,
সমাজে,
গণমাধ্যমে,
জাতীয় সংসদে সর্বত্র জিজ্ঞাসার প্রসার চাই। জিজ্ঞাসার মধ্যে দিয়েই সমাধানসূত্রের পথসন্ধানও সহজ হবে উত্তরোত্তর। এর কোনো বিকল্প নেই। জিজ্ঞাসার প্রসার ঘটলে,
জিজ্ঞাসার সঙ্গে জিজ্ঞাসার দ্বন্দ্বও ঘটবে। সবটাই হোক মাতৃভাষার মাধ্যমে এবং মাতৃভাষা যূথবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করুক। শুধু ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক আলোচনা নয়,
মাতৃভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। সারা বছরই মাতৃভাষাকেন্দ্রিক কথা হোক।
এটাই তো সত্য, বায়ান্নর সড়ক ধরে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে মাতৃভাষা বাংলা সর্বস্তরে এখনো প্রচলন করতে না পারা একুশের অর্থাৎ মাতৃভাষা ও ভাষা শহীদদের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শনের শামিল। ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একুশের স্মরণ মর্যাদাই যেন শেষ কথা না হয়ে থাকে। মূল লক্ষ্য থাকুক দ্রুত সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন। প্রকৃত শিক্ষা ছাড়া মানুষ মানুষ হয় না, আর মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমে শিক্ষা যে অসম্পূর্ণ সেটা যেমন স্বতঃসিদ্ধ, ঠিক তেমনি স্বতঃসিদ্ধ এটাও, বায়ান্নর অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনোদিন কোনোভাবেই বিকশিত হওয়া যাবে না। শ্রেণি নগণ্যসংখ্যকের, কিন্তু ভাষা অনেকের। ভাষা শ্রেণির চেয়ে নিশ্চয় বড়। আমাদের রক্তস্নাত ভাষা শ্রেণির জালে বন্দি রয়েছে কিন্তু এই জাল ছিন্ন করা মোটেও দুরূহ কোনো বিষয় নয়। উচ্চ শিক্ষা, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলনের পথ অমসৃণ রেখে আমরা কি কাঙ্ক্ষিত দেশ গড়ার পথে এগোতে পারব?
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক