প্রেক্ষাপট
সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত
একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
গাজীপুরে পেটিস ও কেক খেয়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই বোন মারা যায়। নিত্যপণ্যের বাজারে উচ্চমূল্য যেমন একটি বড় সমস্যা,
তেমনি খাদ্যে ভেজালও সর্বনাশা। গাজীপুরের ঘটনাটি খণ্ডচিত্র মাত্র। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যে ভেজালসংক্রান্ত কিছু বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন
(সিডিডি)-এর এক জরিপ
অনুসারে প্রতি বছর সারা বিশ্বে অন্তত ৪৮ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ২৮ হাজার হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং প্রায় ৩ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ সমীক্ষাকে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিচার করা কঠিন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওই সংগঠন মূলত কয়েকটি সূচকের ভিত্তিতে এ জরিপ করেছে। তারা খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য পাঁচটি জীবাণুকে দায়ী করেছে। মূলত খাদ্যপণ্য সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও রান্না না করার ফলে ফুড পয়জনিংয়ের শিকার হয় মানুষ। এজন্য তারা বেশকিছু সতর্কীকরণ ও পরামর্শও দিয়েছে। তবে আমাদের দেশে এ কটি সূচকের ভিত্তিতে খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি বিচার করা যাবে না।
প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে কিংবা গবেষণা জরিপে অনিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি উঠে আসছে। একসময় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলতেন,
ব্যস্ততা ও জীবনের তাগিদে মানুষকে দিনের বেশিরভাগ সময় দোকান কিংবা রেস্তোরাঁর খাবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবু যতটুকু সম্ভব বাড়িতে তৈরি খাবার খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত। অথচ এ কথা বলতেও এখন অনেকে দ্বিধাবোধ করেন। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা দিনে দিনে বাড়ছে এবং প্রক্রিয়াগুলো ক্রমেই অভিনব রূপ লাভ করছে। খালি চোখে একজন ভোক্তা এমনকি ভেজাল শনাক্তকরণে দায়িত্বশীল সংস্থাও অনেক সময় তা শনাক্ত করতে পারে না। যেমন পোল্ট্রি পণ্যে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে;
কারণ পোল্ট্রি ফিডে ভেজাল। মিষ্টিজাতীয় খাদ্যদ্রব্যে স্যাকারিন,
বিষাক্ত রং এমনকি মোমও মেশানো হয় আকর্ষণীয় করার জন্য। আমিষজাতীয় পণ্য তাজা ও ভারী করার কারসাজিও আছে। শাকসবজি ঠিকঠাক সংরক্ষণ না করে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় দীর্ঘদিন তাজা রাখার জন্য। আবার অসময়ে ফল পাকানোর জন্যও রাসায়নিক উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলেও সুস্থতা অনিশ্চিত;
কারণ ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব। ভোক্তার এপার-ওপার
দুটোই নেই।
সব দিক বিবেচনা করলে বৈশ্বিক জরিপ ও পরিসংখ্যান যাচাই করে শুধু সামাজিক আন্দোলন গড়ার পরিকল্পনা বোধহয় ভুল। স্মরণে আছে, ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছিল। তার পর থেকে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরও বাজারে প্রায়ই অভিযান চালাচ্ছে এবং দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করছে। কিন্তু দেশের সার্বিক বাজারের আয়তন বিচারে তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিধি কম। খাদ্যে ভেজাল ঠেকাতে হলে জনসচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে এও সত্য, দেশে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যপণ্য সরবরাহের পথ সহজ হলেও সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। পচনশীল খাদ্যপণ্য সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ ও সংরক্ষণাগার নির্মাণের বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্য সংরক্ষণে রাসায়নিকের ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করলেই হবে না, নিয়ন্ত্রণও আনতে হবে। বিশেষত খাদ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের প্রাপ্তিস্থান বেঁধে দিতে হবে এবং অবৈধ পন্থায় তা সংরক্ষণের পথ রুদ্ধ করার ক্ষেত্রেও দৃঢ় ব্যবস্থা নিতে হবে। অতি মুনাফালোভী, অসাধু খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারীদের অপরাধের প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভাগ ও সচেতন মানুষের সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।
লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক