× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পাঠ্যপুস্তকে ভুলের ছড়াছড়ি, দায় কার

শহিদুল ইসলাম

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:৪৭ এএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির বিভিন্ন বইয়ের ভুল কাগজের মান নিয়ে সরকার এনসিটিবির সমালোচনায় সোচ্চার মিডিয়া এবং অভিভাবকরা বইয়ের কাগজের মান এতই খারাপ যে অনেক অভিভাবক অভিযোগ তুলেছেন, মাস ছয়ের মধ্যেই বইগুলো আর নাড়াচাড়া করা যাবে না অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, ‘ততটা খারাপ নয়

কোন ক্লাসের কোন বইয়ে কি ভুল আছে তা কারও জানার বাকি নেই সেদিকে যেতে চাই না তবুও একটি ভুলের কথা না লিখলেই নয় ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস সামাজিক বিজ্ঞান বইতে বঙ্গবন্ধুর বাবার নামের ভুল কি করে সহ্য করা যায়? এনসিটিবির বইয়ের ভুল নিয়ে ২০১৭ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলাম বিষয়টি ধারাবাহিকভাবেই চলছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবছরই নির্ভুল বইয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন কিন্তু তাঁর উপদেশ পরিণত হচ্ছে অরণ্যে রোদনে এনসিটিবির ভ্রুক্ষেপ নেই এদিকে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অদল-বদল করেও উন্নতি হয়নি বছর পূর্বের সব রেকর্ড ভঙ্গ

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলতে হয়, কেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে নির্ভুল বই তুলে দেওয়া যাচ্ছে না? দুটি কারণ খুঁজে বের করেছি এক. সমস্ত কিছুই আমলাতন্ত্রের কঠিন দড়িতে বাঁধা দুই. এত বই ছাপতে বিশাল অর্থের ওপর আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আর একটি কারণ হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কবে থেকে এই বাধ্যবাধকতা চালু হলো? আগে তো এটি ছিল না! এটা সাংবিধানিক কর্তব্যও নয় কোনো দলের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে লেখা দেখিনি কাজেই বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা সরকারের নেই সরকার বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়াকে সাফল্য হিসেবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছে সন্দেহ নেই তাতে শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের আবেগের সৃষ্টি হয়েছে তারা এখন বছরের প্রথম দিনেই বই পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন ধরনের আবেগ সৃষ্টিতে বাজারে মুখোরোচক আলাপপেছনে লুকিয়ে আছে প্রকাশকদের স্বার্থ

 

দুই.


একটু পেছনে তাকানো যাক আমাদের সময়ে একই বই দু-তিন বছর চালানো হতো নিচু ক্লাসের ছাত্র বা তাদের অভিভাবকরা বছরের শুরুতেই ওপর ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বইগুলো সংগ্রহ করতেন আমাকে দেওয়ার জন্য আমিও ওপর ক্লাসের ছাত্রদের আগেই অনুরোধ করে রাখতাম আবার আমার নিচু ক্লাসের ছাত্রদের কেউ কেউ আমাকেও বলে রাখত আমার বইগুলো তাকে দিতে এভাবে যতটা সম্ভব আমরা পুরোনো বই দিয়েই পড়াশোনা করেছি কই, তাতে তো কোনো ক্ষতি হয়নি! এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা পাওয়ার চাবিকাঠি দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা চলছে অথচ সরকার তা বন্ধ করতে পারছে না প্রতিবছর যারা ভুল বই লিখছেন ছাপছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? বদলি বা ওএসডি কোনো শাস্তি নয়

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে প্রতিবছর ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের বই পরিবর্তন করা হবে কেন? ইতিহাস কি বছর বছর পাল্টে যায়? বার্ট্রান্ড রাসেলের কথায় বলতে হয় যে শিক্ষাকাঠামো আগাগোড়া রাষ্ট্র নামক একটি রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের অধীনস্থ তাই তিনি তাঁর সন্তানদের জন্য নিজেই স্কুল স্থাপন করেছিলেন কিন্তু সেটা কোনো সমাধান নয় রাষ্ট্র আজ ব্যক্তির অস্থিমজ্জা গিলে খেয়েছে তাই সবাইকেই রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নাই দেশের মেহনতি মানুষের উৎপাদিত সম্পদ সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালকদের তাই আজকের এই যুগে সবাই রাষ্ট্রের অর্থাৎ সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীকে এভাবে মানসিকভাবে পঙ্গু করার কোনো অধিকারই নেই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোনো সরকারের আজ বর্তমানের আওয়ামী লীগ সরকার যেসব জায়গায় গুরুত্ব আরোপ করছেন, পরবর্তী সরকার সেখানে মোটেই গুরুত্ব না দিয়ে তাদের পছন্দের জায়গায় গুরুত্ব দেবে ফলে একই ইতিহাসের ঐতিহ্য বহনকারী শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়বে এতে প্রতিটি সরকারের ভালো কাজগুলোর গুরুত্ব হ্রাস পাবে

 

তিন.



উন্নয়ন সম্পর্কে সরকার সাধারণ মানুষের ধারণা আলাদা সরকার রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, নতুন নতুন চোখ ঝলসানো আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলাকেই উন্নয়ন বলে ব্যাপক প্রচার করে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের উৎপাদিত সম্পদ বিদেশি ঋণের সাহায্যে এসব কাঠামোগত উন্নয়ন করা হয় আর সাধারণ মানুষের কাছে উন্নয়ন বলতে বোঝায় সারা বছর সন্তানাদি নিয়ে তাদের আয়ের মধ্যেই সংসার চালানো, সুচিকিৎসার গ্যারান্টি, ছেলেমেয়েদের মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি

বছর পাঠ্যপুস্তকের প্রমাদ কতটা ভুল এবং কতটা সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট, সে সম্পর্কে উচ্চপর্যায়ের কমিশন নিয়োগের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে হবে এবং এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে যেন ভবিষ্যতে আর কেউ রকম ভুল করতে না পারে প্রসঙ্গে লিও টলস্টয়ের একটি কথা মনে পড়ল তিনি কোনো এক প্রবন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত শিক্ষা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সরকার শিক্ষার মাধ্যমে আলো ছড়ানোর কথা বলে আসলে তারা অন্ধকার ছড়ায়রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার হেরফেরপ্রবন্ধে ১৯১৩ সালে টলস্টয়ের ওই কথা সমর্থন করেছিলেন বর্তমানের শিক্ষা নিয়ে বিতর্কের সঙ্গে অশিক্ষিত উগ্র মুসলমানরা ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন এটা বিজ্ঞানের পিঠে অস্ত্রাঘাত

মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের বাইরের চাকচিক্য বৃদ্ধি করা যায়; কিন্তু সেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানুষের মনন সৃজনশীলতার কোনোরকম বিকাশ ঘটাতে অক্ষম কেবলমাত্র মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমেই ভারবাহী পশুর মতো মানুষকে একটি প্রবল প্রতাপশালী সম্পদে পরিণত করা সম্ভব স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের মানবসম্পদ তৈরির প্রতি আমাদের অনীহা আজ পর্যন্ত শিক্ষা, গবেষণা স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ সর্বনিম্ন জিডিপির % শতাংশের আশেপাশেই ঘুরছে অথচ আমাদের সরকার ইউনেস্কোর সুপারিশে সম্মতি জানিয়েছে শিক্ষা গবেষণা খাতে জিডিপির % বরাদ্দ দিতে হবেসরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্তৃপক্ষ সে বরাদ্দ দিতে নারাজ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাতটি তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ সন্ত্রাস, লুটপাটের রাজত্ব

সরকার যদি আগ্রহী হয়, তাহলে সব ভেজাল অপসারণ করতে পারবে কিন্তু সুষ্ঠু মানসম্পন্ন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সহজ হবে না মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া অনেক শিক্ষকও আজ পথভ্রষ্ট তারাও শিক্ষাকে এক লাভজনক ব্যবসা হিসেবেই দেখছেন বা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন কোচিং সেন্টার থেকে তাদের সরিয়ে স্কুলমুখী করা সহজ হবে না এদের হাতেই শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়ে দেশের কোনো লাভ হবে না অভিভাবকবৃন্দ অসহায়ের মতো এদের হাতেই সন্তানের মানুষ হওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে মোটেই সান্ত্বনা শান্তি পান না আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি কোচিং সেন্টার বন্ধ করবেন, কিন্ত পারেননি ভবিষ্যতেও কোচিং সেন্টার বন্ধ করা যাবে না কি-না, সেও এক প্রশ্ন

কোনো একটি গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে সরকার ডারউইনের তত্ত্ব পাঠ্যবই থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে খবরটি যদি সত্যিই হয়, তাহলে তা সরকারের বিজ্ঞানবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করবে এখানেই গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা দেশের অধিকাংশ অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারকে ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে সক্রেটিস জন্যই গণতান্ত্রিক সরকার সমর্থন করেননি সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্যের প্রতিফলন নয় ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যদি সত্য উন্মোচিত হতো, তাহলে আজও সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরত কারণ কপারনিকাস যখন সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের কথা বলেন, পৃথিবীর কোনো মানুষ তা বিশ্বাস করত না এমন অনেক উদাহরণের উল্লেখ করা যায়

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিগত ৫০ বছর ধরে চলছে কোনো আধুনিক শিক্ষাদর্শন ছাড়া একমাত্র আলোর আভাস জানিয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই কুদরাত--খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ব্যক্তি দল সে রিপোর্টটি বঙ্গোপসাগরে জলাঞ্জলি দিয়েছিল কিন্তু কোনো উন্নত শিক্ষা কমিশন জাতিকে উপহার দিতে পারেননি শিক্ষা কমিশন ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলছে আমলাতান্ত্রিকতার কড়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনেকটাই অসহায় কারণ আমাদের খুব কম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই শিক্ষার দর্শন, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য বা মোটেই জ্ঞান রাখেন না সরকারের কাছে দাবি, এবারে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যে কেলেংকারির তথ্য উঠে আসছে, তদন্তসাপেক্ষে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুনভবিষ্যতে যেন এমন কাজ কেউ করতে না পারে নির্ভুল পাঠ্যপুস্তক নিশ্চিত করতে না পারলে এর বিরূপ প্রভাব বহুমুখী হতে বাধ্য, যা কোনোভাবেই প্রীতিকর হবে না

লেখক : সাবেক অধ্যাপকরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা