ফারিহা জেসমিন
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:৩৬ এএম
অলঙ্করন : প্রবা
করোনাপরবর্তী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আর্থিক মন্দার এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ সময়ের দাবি। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ আমেরিকার কাছে গুরুত্ব বহন করে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা রয়েছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র তখনই বাংলাদেশকে ৩শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছিল।
উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং সন্ত্রাসকে আস্কারা নয়-এই তিনটি বিষয়ের ওপর
নির্ভর করে বাংলাদেশ- যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি বা বাংলাদেশের
প্রতি আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি বা আমেরিকার বাংলাদেশনীতি । গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার
প্রশ্নে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন
দেখা গেলে এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট
সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর যেন একটা সুসম্পর্কের নববারতা
দিয়ে গেল। উল্লেখ্য,
২০২১
সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ
করে এবং গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে
বাদ দেয়। তবে
ডোনাল্ড
লুর এই সফরে মানবাধিকার প্রশ্নে র্যাবের ওপর জারিকৃত
নিষেধাজ্ঞা , জিএসপি
সুবিধা
স্থগিত করা, নির্বাচনসহ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নানারকম
বক্তব্য প্রদান ইত্যাদি কারণে দুই দেশের মাঝে সৃষ্টি হওয়া দূরত্ব অনেকটাই ঘুচে
গেছে আশা করা যায়।
২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মোহাম্মদ ইমরান বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে
যুক্তরাষ্ট্রস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগদানের পর জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাইডেন ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের ব্যাপারে অত্যন্ত
গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন এবং দুই দেশের মধ্যে পূর্বের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়াও আগামীর
সুসম্পর্কের আশার কথা ব্যক্ত করেন। বিগত ৫০ বছরে
কৃষিনির্ভর
হয়েও চমৎকারভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা
করেন বাইডেন। তার বক্তব্যে এটাই স্পষ্ট হয়েছে, এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা দিলেও এখন বাংলাদেশের সঙ্গে আরও গভীর এবং আন্তরিকভাবে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বলার
অপেক্ষা রাখে না, এশিয়ার বৃহৎ শক্তি চীনের উত্থানের এই
মুহূর্তে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
চলাকালীন সময়ের ইতিহাস অন্য কথা বললেও আমেরিকা-বাংলাদেশ সম্পর্ক ৫০ বছরের পুরনো। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের মাটি থেকে
ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ আমেরিকার একটি অন্যতম
মিত্র দেশে পরিণত হয়। এরপর থেকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও
বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন,
মানবিক
বিষয়াদি, উদ্বাস্তু সমস্যা,
জাতিসংঘ
শান্তিরক্ষা মিশন, সন্ত্রাস দমন, সামুদ্রিক এবং অন্যান্য
নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমানে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সশস্ত্র
বাহিনীর আধুনিকীকরণে সহায়তা করতেও আগ্রহী ।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে বিশ্বের বৃহত্তম দুই
অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও
চীনের ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অর্থনীতি,
প্রতিরক্ষা, শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রায় সব পর্যায়ে বিস্তৃত, যাকে একটি পূর্ণ দ্বিপক্ষীয়
সম্পর্ক বলা যায়। এই সম্পর্ক আরও জোরদার হয় যখন ২০০০ সালের
২০ মার্চ প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর
করেন। এটি ছিল প্রথমবারের মতো কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। বাংলাদেশ
সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। রপ্তানি করা পণ্যের
মধ্যে রয়েছে তৈরি
পোশাক,
জুতা,
টেক্সটাইল
সামগ্রী ও কৃষিপণ্য। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রায়
দেড় শ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল।
অধিকাংশই
বস্ত্র ও তৈরি পোশাক হলেও ২০২০-২১
অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৬৯৭
কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। অন্যদিকে ওই বছরেই বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়ে ব্যাপক হারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট
আমদানির প্রায় ৫
শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ওই
বছর দেশে ২১২
কোটি ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের মার্কিন পণ্য আমদানি হয়। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি ও স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে দেশে এফডিআইর সবচেয়ে বড়
উত্স যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ
বিনিয়োগ ছিল ৪৬ কোটি ডলার,
যা
২০১৬ সালের তুলনায় ০.৪ শতাংশ বেশি। দেশের মোট
এফডিআইতে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। এর মধ্যে জ্বালানি তেল
ও গ্যাস, ব্যাংকিং
ও বীমা এবং
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগগুলো এসেছে ।
২০১৩
সালের এপ্রিল মাসে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসের ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে
শ্রমিক অধিকার এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুন মাসে দেশটির
জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) বাণিজ্য সুবিধা স্থগিত
করে। জিএসপির ওপর স্থগিতাদেশ বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়
বাণিজ্যের ওপর সামান্যই তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য বস্ত্র ও তৈরি পোশাক জিএসপি সুবিধার আওতাভুক্ত নয়। তবে পুনরায় জিএসপি
সুবিধা ফিরে পাওয়ার শর্তপূরণের অংশ হিসেবে
যুক্তরাষ্ট্র যে কর্মপরিকল্পনা দেয়, তার মাধ্যমে বাংলাদেশ
বেশকিছু অগ্রগতি লাভ করেÑ বিশেষ করে পরিদর্শন,
সুরক্ষা
ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে। এ
ছাড়া
যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে আরও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে
বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের
তৈরি পোশাকের জন্য আমেরিকা একটি বিরাট একক বাজার,
রয়েছে
রপ্তানির প্রচুর সুযোগ-সম্ভাবনা। প্রতিবছর বেড়ে
চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশি
তৈরি
পোশাকের ব্যাপক চাহিদা ও জোগান। একটু কৌঁসুলি হলে,
বাণিজ্য
আরও সহজ করে দিলে, পোশাক কারখানার
কর্মপরিবেশ
আরও উন্নত এবং নিরাপদ হলে অন্য যেসব দেশ থেকে তারা
পোশাক কেনে; যেমন- ভিয়েতনাম, ব্রাজিল বা চীন তাদের বাদ দিয়ে মার্কিন
ক্রেতারা বাংলাদেশের প্রতি আরও আকৃষ্ট হবে। যদি এই সুযোগ কাজে লাগানো যায়, তাহলে
দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমেই আরও দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়