জন্মদিন
অলঙ্করন : প্রবা
এ দেশে একটা সময় ছিল, যখন কবিরা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বিবেচিত হতেন। কোথাও কবি আসছেন শুনলে মানুষ ছুটে আসত কবিকে দেখবে বলে। অবাক বিস্ময়ে কবির দিকে তাকিয়ে থাকত—তাহলে এই মানুষটাই তিনি, যে কি না অগণন মানুষের অনুভূতি শব্দে ধরে ফেলছেন, বানাচ্ছেন কল্পনার সৌধ! কামাল চৌধুরী সেই যুগের কবি। সেই পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর চলে গেছে, আছেন শুধু যুগের প্রতিনিধিরা। কবি কামাল চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা’য় অন্তর্ভুক্ত ‘মাছাইমারা’ শিরোনামে কবিতার কয়েকটি পঙক্তি এ রকম— ‘ভোর; অসংখ্য পেনিকেলের ডাকে মুখরিত ভোর/ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে দিয়ে ক্যামেরার চকিত নেত্রপাতের মতো ভোর/হিপোপুলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা জলহস্তীর ক্রীড়াময় ভোর/পর্যটকের গাড়ি চাপা-পড়া মৃত হায়েনার চারপাশে/শোকার্ত হায়েনাদের করুণ ও ক্রুদ্ধ চোখের মতো ভোর।’ ক্রমাগত চমকে দেবে সারিবদ্ধ চিত্রকল্পের এই কবিতা। এটি উল্লিখিত বইয়ের শুরুর দিকের কবিতা নয়। তবু এটাকে প্রথমে টেনে আনার কারণ, কাব্যগ্রন্থের শুরু বা শিরোনাম কবিতার অনুপম দেয়াল।
শুরুর সেই অনুপম দেয়াল পাঠক হিসেবে আমাকে এ বইয়ে কবির বানানো যে জগৎ,
সেই জগতে প্রবেশের আগে একটা বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে বইয়ের শিরানাম কবিতা,
একই সঙ্গে প্রথম কবিতাও ‘উড়ে যাওয়া
বাতাসের ভাষা’য় প্রবেশ
করতে গিয়ে এ কবিতা একাধিকবার পাঠ করতে হয়েছে। সে পাঠের প্রথম দফা এমনকি দ্বিতীয় দফায়ও মনে হয়েছে,
কবিতাটি এলোমলো কিছু শব্দ-উপমার
ছড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আবিষ্কার করা গেল,
বইটার প্রবেশপথ আসলে এই কবিতা। অথবা বলা যায়,
বইয়ের একটি ইঙ্গিত;
সারাৎসার। এটা কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা ‘স্বপ্ন’র ক্ষেত্রেও বলা যায়। এ দুটি কবিতা আপাত দুর্ভেদ্য,
এলোমেলো। কিন্তু এ দুটি মিলে পুরো বইয়ের বা একই সঙ্গে কবির সৃজনজার্নির একটা ইঙ্গিত রয়েছে। তবে এটা নয় যে,
বইয়ের অন্য কবিতাগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে,
শুরুতে একটা যুগপৎ সংকট এবং মুগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছেন কবি। সংকটটা এমন যে,
এই দেয়াল পার হয়ে অনেকেই বইয়ের আস্বাদন নিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। আর মুগ্ধতা আবিষ্কারের,
যখন কবিতা দুটির ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে;
তখন মনে হবে সূত্র আবিষ্কার করা গেল।
নানা পথ-উপপথের সন্ধান একে একে উন্মোচিত হতে থাকল যে। ‘শেষরাতের ট্রেন’ শিরোনামে আরেকটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তিÑ ‘শেষরাতের ট্রেন থেকে নেমে গেছে/প্রাচীন উপকথার নায়িকারা/তাদের শাড়ির রঙে জেলেপাড়ার টেরাকোটা/সেখানে শিল্পীর হাতে ক্রমাগত ফুটে উঠছে/জাতিস্মর মাটিকন্যা’। এভাবে পরিক্রমণ করতে গেলে দেখা যাবে, একের পর এক পঙক্তি ধরা দিচ্ছে নানা রঙে, নানা রূপে; যারা কাব্যগ্রন্থের পৃষ্ঠায় বসে আছে। ধরা যাক ‘নির্জন গ্রন্থাগার’, ধরা যাক ‘নায়াগ্রা : মেইড অব দ্য মিস্ট’। এ রকম প্রায় প্রতিটি কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা, শব্দের ব্যবহারে এক জগৎ তৈরি হয়েছে; যা কবির নিজস্ব, যা পাঠে আমরা কম্পিত হতে থাকি কী শব্দে, কী উপমায়, কী একটা দৃশ্যময় জগতের খোঁজ পেয়ে। এই ছোট্ট আলোচনায় কামাল চৌধুরীর একটি কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতা সামান্য বিশ্লেষণ মাত্র। যদি ছন্দের কথা আসা যায়, কবিতায় ব্যবহার করা অনুষঙ্গের কথায় আসা যায় তাহলে এ ব্যাপ্তি অনেক বেড়ে যাবে। সে আলোচনার ইচ্ছাটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া গেল। ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩-এ তিনি ৬৬ বছর পূর্ণ করলেন। ৬৬ বছরে এসে তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা হিসাবে খুব বেশি নয়, আবার কমও নয়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মিছিলের সমান বয়সী’ প্রকাশের পর দীর্ঘ বিরতি শেষে আবার যে যাত্রা, সে কাব্যযাত্রায় নিজেকে ভেঙেচুরে নতুনভাবে আবিষ্কারের ক্রমাগত চেষ্টা প্রবলভাবে দেখা যায় তার কবিতায়। একই সঙ্গে দেখা যায়, নিজেকে আরও নিখুঁত করে তোলার ক্রমাগত চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছেন। ফলে এভাবে একটা সময় কম আলোচিত থাকা এই কবি দিন দিন ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছেন পরিণত বয়সে। নির্মাণ করছেন পরিণত কবিতার এক সরোবর। তার এ কাব্যযাত্রা চিত্রকল্পের-উপমার এক মোহনযাত্রা হতে থাকুক। যথাযথ ছন্দের বাগানে অক্ষরের দল হয়ে উঠুক একেকটি দারুণ পুষ্প। জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি