× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্রাণপ্রকৃতি হত্যার ন্যায়বিচার হোক

পাভেল পার্থ

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ ০২:৫৭ এএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

পুড়িয়ে-পিটিয়ে বন্যপ্রাণী হত্যার ঘটনানতুননয় প্রজাতি হিসেবে কেবল মানুষই সৌরজগতে এই কাজটি করতে পারে হনুমান বা বকপাখি কখনই এই কাজ করে না তাই বন্যপ্রাণীদের অভিধানেজঘন্য নৃশংসবলে কোনো শব্দ নেই দেশের বৃহৎ পরিবেশ-গণহত্যামাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডথেকে শুরু করে সুন্দরবন, মধুপুর লাউয়াছড়াতে আগুনে পুড়ে নিহত হয়েছে বহু প্রাণ এসবের কোনোটি ঘটেছে অক্সিডেন্টালের মতো বহুজাতিক কোম্পানির খননের মাধ্যমে, কোনোটি আবার কোনো কর্মসূচির কারণে আবারও হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত দেশের এক অনন্য সংবেদনশীল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেমা-কালেঙ্গার বহু বন্যপ্রাণী উদ্ভিদ আগুনে পুড়ে মারা গেছে বহু প্রাণী আহত জখম হয়েছে বহু প্রাণীর আশ্রয়, বিচরণ আবাসস্থল এবং খাদ্যউৎস নিশ্চিহ্ন হয়েছে রেমা-কালেঙ্গা বনলাগোয়া হাতিমারা চা-বাগান কর্তৃপক্ষের দেওয়া আগুনে এই নিদারুণ ঘটনাটি ঘটেছে চা-বাগানের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে মায়া হরিণ, পাখি, হনুমান কাঠবিড়ালির মতো বহু বিরল বুনোপ্রাণ গণমাধ্যম জানিয়েছে, নিজেদের ইজারা নেওয়া জায়গার প্রায় ১৪০টি প্রাচীন বৃক্ষ কেটে চা-বাগান সম্প্রসারণের জন্য এই আগুন দেয় চা-বাগান কর্তৃপক্ষ কেটে নেওয়া গাছগুলো অর্ধশত শত বছরের পুরোনো গাছগুলোর ফল প্রাণীদের খাদ্য এর মধ্যে বেশকিছু ছিল ফলের গাছ এই গাছগুলো উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অসংখ্য বন্যপ্রাণীর খাদ্যের জোগান দিত গাছ কেটে বনে আগুন দেওয়ায় কয়েক প্রজাতির বানর, হনুমান, মায়া হরিণ শূকরসহ নানা প্রজাতির প্রাণী আশ্রয় হারিয়েছে সেই সঙ্গে রুদ্ধ হয়ে গেছে বন্যপ্রাণীর খাদ্যের স্বাভাবিক জোগান বাগান কর্তৃপক্ষ কেবল আগুন লাগিয়ে বন্যপ্রাণী হত্যাই করেনি, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গাছ কেটে এই ভূমির শ্রেণিও পরিবর্তন করেছে তারা টিলাভূমি কেটে সমান করেছে বনতল, ঝোপ, লতাগুল্ম সব ধ্বংস করেছে আমলকী, বহেরা, আউলা, আম, জাম, তেঁতুল, বট, কাঁঠালের মতো দেশি বৃক্ষপ্রজাতিগুলো কেটে ফেলেছে চা-বাগান সম্প্রসারণের নামে একটি বাস্তুতন্ত্র লণ্ডভণ্ড করে বহু বন্যপ্রাণ হত্যার এই ঘটনাটি দেশের বিদ্যমানবন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর চূড়ান্ত লঙ্ঘন আশা করব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে

ধরিত্রীর সবুজ প্রকৃতির মধ্যে বেঁচে আছে আমাদের প্রাণ মানুষ, উদ্ভিদসহ সব বন্যপ্রাণী এই প্রকৃতিতেই বেড়ে উঠেছে, নিজেদের জন্য গড়ে নিয়েছে আবাসস্থল আবার এই প্রকৃতিকেই ধ্বংসের লীলায় মেতে উঠেছে মানুষ ফলে মারা পড়ছে বনের সবুজ পাখি, অবুঝ প্রাণী এই ঘটনায় এক দল যেমন প্রবলভাবে আহত হচ্ছে, আবার আরেক দল অব্যাহত রাখছে আগুন দিয়ে বন পরিষ্কারে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে মেলবন্ধন তা ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে পৃথিবী থেকে এই মাটি, এই বন এই সবুজ আমাদের জীবনীশক্তির বাহক এর ওপর ভর করেই বিকশিত হয়েছে মানুষসহ সব প্রাণীর জীবন এই ধরিত্রীর সবুজ বেঁচে না থাকলে মানুষও বেঁচে থাকবে না আমরা কি এই কথা ভুলতে বসেছি?

দশ কি বারো হাজার বছর আগে প্রাণবৈচিত্র্যের গণবিলুপ্তি ঘটিয়েই কৃষির সূচনা বিকাশ পরে চা, কফি, নীল, আখ, তামাক, ভুট্টার মতো ফসলগুলোর বাণিজ্যিক আবাদ প্রাণবৈচিত্র্য বাস্তুতন্ত্রের ভয়াবহ বিলুপ্তি ঘটিয়ে চলেছে দীর্ঘকাল এক-একটি চা-বাগান তৈরি হয়েছে স্রেফ লাখো বুনোপ্রাণ আর তাদের সংসারকে নিখোঁজ নিরুদ্দেশ করেই এক কাপ চা মানে বহু বুনোপ্রাণের নির্দয় রক্তস্মৃতি সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা খাগড়াছড়ির পাবলাখালীর পর এটি দেশের বৃহত্তম বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ১৯৮২ সালে একে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয় প্রায় ৪৪৩৬.৭১ একর আয়তনের এই বনটি চরিত্রের দিক থেকে মিশ্র চিরহরিৎ লজ্জাবতী বানর, উল্টোলেজি বানর, পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালি, চশমাপরা হনুমান, উল্লুক, বনরুই, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, শজারু, গন্ধগোকুল, শূকর, সাপ নানা জাতের পাখির আবাসস্থল এই বন হাতিমারা চা-বাগান মায়া হরিণের পছন্দের জায়গা এখানে থাকা আউলা নামে একটি গাছের ফল মায়া হরিণ খায় প্রজাতির গাছগুলোও কেটে ফেলা হয় বৃহৎ মালায়ান কাঠবিড়ালি কেবল বাস করে এই বনেই এই বনে আছে বিরলসব ঔষধি লতাগুল্ম মোট ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদবৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন দেশের সর্ববৃহৎ শকুনের বিচরণস্থলও এই বন ওখানের ময়নাবিল এলাকায় প্রায় ৩৮টি শকুন পরিবারের বাস দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের পাশে অবস্থিত গির্জাঘর এলাকাটি বন্যপ্রাণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েক প্রজাতির বানর, হনুমান, মায়া হরিণ শূকরসহ নানা প্রজাতির জীবজন্তুর প্রধান আশ্রয়স্থল হাতিমারা চা-বাগানটি রেমা-কালেঙ্গা বনের প্রতিবেশ অঞ্চলেই অবস্থিত

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের পাশে প্রায় তিন হেক্টর জায়গার বনজ ফলদ ভেষজ গাছ কেটে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে বনের জীবজন্তু আগুনে পুড়ে মারা যায় বন এবং চা-বাগানের আদিবাসী স্থানীয় মানুষরা কয়েকদিন ধরে বহু বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়েছেন আতঙ্কিত, আহত বন্যপ্রাণীর অসহায় করুণ ছোটাছুটি দেখেছেন চা-বাগান কিংবা বন বিভাগ কেউ এই আহত-নিহত বন্যপ্রাণীর পাশে দাঁড়ায়নি এই পরিবেশবিনাশী চা-বাগান সম্প্রসারণ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ

কোনো অরণ্য বাস্তুতন্ত্রে অগ্নিকাণ্ড বা এর ভূমিরূপের শ্রেণি পরিবর্তন সেই অঞ্চলের প্রাণ প্রকৃতিতে বড় ক্ষত তৈরি করে এই ক্ষত সারাতে প্রকৃতির বহু সময় লাগে দেখা গেছে অগ্নিকাণ্ডে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বনতল এবং মৃত্তিকা বাস্তুসংস্থান কারণ বৃহৎ বৃক্ষ বড় প্রাণীর লাশের হিসাব করা যায়; কিন্তু মাটির অণুজীব খুদে উদ্ভিদ, পতঙ্গ প্রাণীর হিসাব সব সময় আমাদের পরিসংখ্যানের বাইরে থেকে যায় অথচ সকল প্রাণের জটিল সম্পর্ক সম্মীলন ছাড়া একটি অরণ্য বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে না হাতিমারা চা-বাগানকে জায়গাটি ইজারা দেওয়ার আগে রেমা-কালেঙ্গার মতো বনের গুরুত্ব বিবেচনা করা দরকার ছিল আমরা চাইলে বহু চা-বাগান বানাতে পারব; কিন্তু একটি রেমা-কালেঙ্গা বন তৈরি করতে পারব না তাহলে এমন বনের আশপাশে চা-বাগান সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া এবং কর্মপদ্ধতি কেমন হবে, সে বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি চা-বাগানের নামে এত বুনো প্রাণের প্রাণহানি স্পষ্টতই প্রমাণ করে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ, পরিবেশবান্ধব এবং দেশের জন সম্পদের প্রতি দায়িত্বশীল নয় বাংলাদেশের সংবিধান পৃথিবীর এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যেখানে পরিবেশ প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার অঙ্গীকার আছে সংবিধানের ১৮ () ধারায় উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ উন্নয়ন করিবেন এবং প্রকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করিবেনবাগান সম্প্রসারণের নামে হাতিমারা চা-বাগান বন্যপ্রাণী হত্যার ভেতর দিয়ে সংবিধানের এই ধারা লঙ্ঘন করেছে দেশে প্রাকৃতিক বনভূমি খুব বেশি নেই, আবার চা-বাগানগুলো সম্প্রসারণ করতে হলে প্রাকৃতিক বনভূমি বাস্তুতন্ত্রের ধারেই করতে হচ্ছে

রাষ্ট্র কী পারবে হাতিমারা চা-বাগান কর্তৃপক্ষকে আইনের আওতায় আনতে? অবশ্যই পারবে এর আগে ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল বন বিভাগের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে লাউয়াছড়া বনে আগুন লাগে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় কমলগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ইউনিট বন বিভাগ আগুন নেভাতে সক্ষম হয় তৎক্ষণাৎ তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ ঘটনার তিনদিন পর ২৮ এপ্রিল বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে কমিটি কমিটি তদন্তে প্রকাশ করে ২০২০-২১ সালের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন বন্যপ্রাণীর খাদ্যসংস্থান তৈরিতে বন-বাগান সৃষ্টির জন্য ঝোপঝাড়, আগাছা, লতাগুল্ম কর্তন করতে গিয়ে আগুনের সূত্রপাত এবং এতে দেড় একর বনে আগুন ছড়িয়ে যায় তদন্ত প্রতিবেদন সুপারিশ করে, ভবিষ্যতে বনে ধরনের আগুন লাগার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য বন বিভাগের মাঠপর্যায়ের স্টাফদের আরও তদারকি বাড়াতে হবে এবং প্রাকৃতিক বনে জন্মানো সব গাছের প্রতিই যত্নবান হতে হবে লাউয়াছড়া বন তদন্ত প্রতিবেদনের সেইসব সুপারিশ মেনে চলার চেষ্টা করেছে আশা করি, এবারও রেমা-কালেঙ্গা বন বন্যপ্রাণের ন্যায়বিচার সুরক্ষায় আরেকটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত হবে

 

পরিচয়-লেখক  গবেষক

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা