× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বামপন্থিরা যা পারেননি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:১৭ পিএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

স্বাভাবিক প্রবণতাতেই রাষ্ট্র বামপন্থিদের প্রধান শত্রু হিসেবে দেখে এসেছে এবং তাদেরকে দমনে সক্রিয় থেকেছে। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয় এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্য ছিল, পাকিস্তান আমলে মিথ্যা হবে কি আরও বড় রকমের সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। জিন্নাহ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়েছেন, আইয়ুব খানও তাদের বিরুদ্ধে সর্বদাই বলেছেন। ১৯৫৮-তে যে সামরিক শাসন আনা হয় তার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল সাধারণ নির্বাচন দিলে বামপন্থিরা জয়ী হবে এই শঙ্কা। সোহরাওয়ার্দী আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে বলেছেন, কিন্তু তাঁরও সম্ভাব্য প্রধান শত্রু ছিল কমিউনিস্টরাই। যাদেরকে দমন করার জন্য তিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু বামপন্থিরা এখন কোথায়? না, তাদেরকে তেমন সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ অবশ্যই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন; তবে আত্মগত কারণও তো রয়েছেই।

রাষ্ট্রের বিরোধিতা ব্রিটিশ আমলেও কম ছিল না। জাতীয়তাবাদীদের তুলনায় কমিউনিস্টদের শক্তি ছিল কম; কিন্তু তুলনায় তাদেরকে বিপজ্জনক মনে করা হতো আরও বেশি। কারণ রাষ্ট্র জানত যে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা হস্তান্তরে সন্তুষ্ট থাকবে না, তারা চাইবে বিপ্লব। তাদের শক্তি কমবে না, বরং বাড়তেই থাকবে। তাদেরকে তাই মামলা দিয়ে জব্দ করা হয়েছে, তাদের দলকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা তৎপরতার তো কোনো বিরাম ছিল না। ওদিকে বামপন্থিদের জন্য অপরিহার্য ছিল জ্ঞানের যে চর্চা, কমিউনিস্টরা তা করতে পারেননি। বইপত্র যা আসত তা বাইরে থেকেই এবং সেগুলো আসার ওপর বিধিনিষেধ ছিল। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে শ্রেণিচেতনার আবশ্যকতা ছিল, তাকে বিকশিত করার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। শ্রেণিপ্রশ্নের মীমাংসার আগে অন্য দুটি প্রশ্নের মীমাংসা দরকার ছিল একটি প্রশ্ন স্বাধীনতার, অপর প্রশ্নটি জাতীয়তার। পরাধীন দেশে বিপ্লব ঘটাবার আগে আবশ্যক ছিল পরাধীনতার অবসান ঘটানো। আর এই পরাধীনতা ছিল সর্বত্রবিস্তারী। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ভেতর সবচেয়ে ধুরন্ধর ছিল ইংরেজরাই। তারা অনুগত একটি শ্রেণি সৃষ্টি করেছে এবং সেই শ্রেণি ও তাদের সহায়তায় বিস্তৃত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের মনোজগতে আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ইংরেজদের সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণিই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করেছে; তারা বিপ্লব চায়নি, ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছে। বামপন্থি আন্দোলনের নেতৃত্বও ওই মধ্যবিত্তশ্রেণি থেকেই এসেছে; নিজেদের শ্রেণিচ্যুতির ব্যাপারে এঁরা অনেক দূর এগিয়েছেন। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই পুরোপুরি শ্রেণিচ্যুত হতে সমর্থ হননি। বুর্জোয়া উদারতাবাদের যে আধিপত্য সমাজে বিদ্যমান ছিল, তার প্রভাবে ঔপনিবেশিক ওই মধ্যবিত্ত সংস্কারেই সন্তুষ্ট থেকেছে, বিপ্লবকে চরমপন্থা ভেবেছে। তা ছাড়া বিপ্লবে তাদের স্বার্থ যে বিপন্ন হবে, এই বোধ তো ছিলই।

পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করাটাই ছিল প্রথম কাজ। সে কাজে জাতীয়তাবাদীরাই ছিলেন সামনে। কমিউনিস্টরা যে সামনে চলে আসবেন, সেটা সম্ভব ছিল না। কারণ তাঁরা ছিলেন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং বিপ্লবের স্বার্থেই যে স্বাধীনতা প্রয়োজন এই বোধটা তাঁদের মধ্যেও ছিল অনিবার্যভাবেই, যে জন্য স্বাধীনতা অর্জনকে তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন। আর ছিল জাতিপ্রশ্নের মীমাংসার প্রশ্ন। জাতীয়তাবাদীরা এটা স্বীকার করতে চাননি যে ভারতবর্ষ এক বা দুই জাতির দেশ নয় এটি একটি বহুজাতিক উপমহাদেশ। জাতীয়তাবাদীরা সম্প্রদায়কেই জাতি বলে গ্রহণ করেছিলেন। কমিউনিস্টদের ভেতর বহুজাতিকতার ধারণাটা ছিল; কিন্তু প্রবলভাবে ছিল না এবং জাতীয়তাবাদীদের আধিপত্যের অভিঘাতে ও শাসক ইংরেজদের দিক থেকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নানাভাবে উৎসাহিত করার দরুন, ভারতবর্ষ যে একটি বহুজাতিক দেশ এই জ্ঞানটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন এবং জাতিগত (যদিও আসলে তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাম্প্রদায়িক) স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন এই দুই ধারণার প্রচার করে এবং সেই সঙ্গে নিজেদের শ্রেণিগত শক্তি ও শাসকদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ আনুকূল্য পেয়ে, দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদীরাইÑ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং নিখিল-ভারত মুসলিম লীগই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তৎপর থেকেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিলে স্বাধীনতার নামে ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে তবে ছেড়েছেন। কমিউনিস্টদের দায়িত্ব ছিল ভারতবর্ষকে একটি ফেডারেল ব্যবস্থার ভেতরে এনে একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা, যাতে করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথটা প্রশস্ত হয়। সেটা তাঁরা করতে পারেননি। না পারার পেছনেও বস্তুগত কারণ ছিল। বস্তুগত একটা কারণ আবার ওই জাতিগত বিভাজনই। ভারতবর্ষীয়রা এক ভাষাভাষী ছিলেন না; তাদের ভেতর যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। সেটা ছিল একদিকে যেমন কৃত্রিম, অন্যদিকে এবং একই সঙ্গে ঔপনিবেশিকতাকে সাংস্কৃতিকভাবে মেনে নেওয়ার পরিচয়বহ। যোগাযোগের আরও অন্তরায় অবশ্য ছিল। যেমন ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এবং সর্বোপরি পুলিশের তৎপরতা। কমিউনিস্টদের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করাটা ছিল বিপজ্জনক। প্রথম দিকে নেতাদের সবাই যে সরাসরি চিনতেন এমনও নয়। নাম শুনেছেন, দেখা হয়নি।

কমিউনিস্ট পার্টির নিজের আত্মগত দুর্বলতাও ছিল। প্রধান দুর্বলতা পরনির্ভরতা। পার্টি দেশের ভেতর থেকে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রয়োজনবোধ, অনুপ্রেরণা ও জ্ঞানানুশীলনের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি; ধারণা এবং বইপত্র এসেছে বাইরে থেকে এবং পরবর্তীতে পার্টিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে; পথনির্দেশের জন্য। কমিউনিস্টদের কর্তব্যগুলোর মধ্যে বড়মাপের একটি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট বাস্তবতাকে বস্তুগতভাবে স্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করা; পার্টি যেটা সব সময়ে করতে পারেনি। একটা কারণ জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক অনুশীলন ও পারস্পরিক আদানপ্রদানে নানাবিধ বিঘ্ন, অপরটি বিদেশনির্ভরতা।

আত্মগত ও বস্তুগত উভয় অন্তরায়ের ভেতর মস্ত বড় আকারে কার্যকর ছিল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোজগতে উপনিবেশিতার প্রভাব তো ছিলই, সঙ্গে ছিল আধ্যাত্মিকতার প্রতাপ। এই উপমহাদেশে বস্তুবাদী দর্শনের চর্চা যে হয়নি তা নয়, হয়েছে; কিন্তু তাকে উৎসাহিত করা হয়নি। উৎসাহিত করবে কি, শাসকশ্রেণি তাদের নিজস্ব স্বার্থে দর্শনচর্চার বস্তুবাদী ধারাটিকে সমূলে উৎপাটিত করতে সচেষ্ট থেকেছে। ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনও আধ্যাত্মিকতার চর্চাকে নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছে। সব মিলিয়ে ভাববাদিতাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ভাববাদিতা যে বস্তুবাদিতার প্রধান প্রতিপক্ষ, সে বিষয়ে তো কোনো দ্বিমত নেই। কমিউনিস্টরা কমিউনিস্ট হবেন কি করে যদি বস্তুবাদী না হন?

কমিউনিস্ট তাকেই বলা হয়েছে যে কমিউনিস্ট নিজেদের বক্তব্য ও লক্ষ্যকে লুকিয়ে রাখাকে ঘৃণা করেন; ভারতের কমিউনিস্টরা তাদের বক্তব্য ও লক্ষ্যকে প্রচার করার সুযোগ খুব কমই পেয়েছেন। আর প্রচার না করতে পারায় বক্তব্য নিজেদের কাছেও পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি। এটা অবশ্য কেবল যে বাংলাদেশের ব্যাপারেই সত্য এমন নয়। সারা বিশ্বেই এখন পুঁজিবাদের অপ্রতিহত দুঃশাসন চলছে। পুঁজিবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী হবে এটা অনিবার্য। সেটা তারা হয়েছেও। বাঘ কী তার মুখের দাঁত ও গায়ের দাগ বদলে ফেলে দিতে পারে? আধুনিককালে বিশ্বে যে দুই-দুইটি প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ ঘটেছে, তার আসল কারণ তো পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের ভেতর আধিপত্য নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদই। তিন নম্বর বিশ্বযুদ্ধেরও অশনিসংকেত শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল; ঘটেনি যে তার কারণ দ্বন্দ্বের মীমাংসা নয়। কারণ হচ্ছে বিবদমান দুই পক্ষের উভয়ের হাতেই ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্রের প্রাচুর্য। তবে স্থানীয় যুদ্ধ তো চলছেই। রাশিয়া যে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে, সেটা তো পুঁজিবাদী দুই বড় শক্তির লড়াই ছাড়া অন্যকিছু নয়। রাশিয়া বিলক্ষণ জানে কার বিরুদ্ধে লড়ছে, আমেরিকারও তালে আছে এই সুযোগে রাশিয়াকে সিজিল করবার।

পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার পুতিনকে বলছে নব্য হিটলার। সেই অভিধা মিথ্যা নয়; তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যে কম যান না সেটা অমান্য করবে কে? ব্যবধানটা গুণের নয়, পরিমাণেরই। তবে পুঁজিবাদীরা নিজেদেরকে সরাসরি পুঁজিবাদী বলতে চান না, বয়স যদিও নিতান্ত কম হয়নি, তবু লুকোচুরি খেলেন। তাদের দ্বারা প্রভাবিত গবেষক ও বুদ্ধিজীবীরাও নিজেদের লেখায় পুঁজিবাদ পর্যন্ত না গিয়ে করপোরেট পুঁজি, বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন ইত্যাদি পর্যন্ত পৌঁছে থেমে যান। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন বিশ্ব যে এখন ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে সেটা বললেও, এর জন্য দায়িত্ব যে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা ভিন্ন অন্যকিছু নয়, সেই মোটা কথাটা বলতে সঙ্কোচ বোধ করেন। তবে আবরণে যে আর কুলাবে না, দানবটি এতটাই স্থূল, বৃহৎ ও জুলুমবাজ হয়ে পড়েছে যে তাকে ভদ্রগোছের অন্য কোনো নামে ডাকবার সুযোগ যে আর নেই, সেই সত্যটি এখন সামনে চলে এসেছে। পুঁজিবাদই যে দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে এবং মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য সবকিছুরই যে সে এখন মূল শত্রু সেই সত্যটা সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।

লেখক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা