২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:১৩ পিএম
অলঙ্করন : প্রবা
‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং/র্যাগিং প্রতিরোধসংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে সরকার। শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদে লেখাপড়া করতে পারে তা নিশ্চিত করতেই এ উদ্যোগ। নীতিমালাটি শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে বলে জানতে পারলাম। খসড়ায় দেখতে পাচ্ছি বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, অভিযোগ বাক্স রাখা এবং ক্যাম্পাসে অ্যান্টি-বুলিং ও অ্যান্টি-র্যাগিং দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বুলিংকারী এবং ভিকটিম উভয়কেই কাউন্সেলিং করা উচিত বলেও মত দিয়েছে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি। নিশ্চিতরূপেই বলা চলে, এটি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। আমাদের স্বীকার করতেই হবে, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং বিষয়টি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০২১-এর ৮
জুলাই। সেখানে দেখতে পাই, এক কিশোরের মৃত্যুর পর তার পরিবার অভিযোগ করেছে, স্কুলের
সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিংয়ের শিকার হয়ে কিশোরটি মারা গেছে। কিশোরের বাবা বিবিসিকে বলেছেন, তার ছেলের ওজন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি
হওয়ার কারণে, স্কুলে তাকে প্রায় নিয়মিতই বুলিং ও উপহাসের শিকার হতে হতো। উপহাস থেকে
বাঁচতে সে খাবার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। ওই সময়টায় সে খেতে ভয় পেত। যদি ওজন বেড়ে
যায় তাহলে আবার স্কুলে সবাই খ্যাপাবেÑ এমন একটি ভয় চেপে বসেছিল তার মনে। ৯৩ কেজি
ওজনের ছেলেটি একসময় ২৯ কেজিতে দাঁড়ায়। খাবার না খাওয়ার ফলে অ্যানোরেক্সিয়া ও বুলিমিয়া
নামক ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়। একসময় তাকে হাসপাতালে
ভর্তি করতে হয়, কিন্তু ততদিনে তার ইমিউনিটি
অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে কমে যায়। শেষ পর্যন্ত কিশোরটির মৃত্য হয়। এ ঘটনার পর ছেলেটির বাবা বলেছেন, ‘বছর দুয়েক পরিস্থিতি এমন হলো
যে, সে প্রায়ই স্কুলে যেতে চাইত না। স্কুলে যাওয়ার আগে বা কখনও স্কুলে যাওয়ার পর
সে অসুস্থ হয়ে পড়ত।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠীদের ব্যঙ্গবিদ্রূপের শিকার হলে
তার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে তা এ ঘটনায় পরিষ্কার। এ বুলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে র্যাগিংয়ে
পরিণতি লাভ করে, যার মাত্রাও ভয়াবহ। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। বুয়েটের আবরার হত্যার
যে রাজনীতি সেও ব়্যাগিংয়ের চূড়ান্ত রূপ, যার পরিণতিতে ছেলেটির মৃত্যু হয়। বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ
থাকে না। অনেক সময় সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেওয়ার
মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে চায়। কেউ কেউ লেখাপড়া
ছেড়েই দেয়। তাদের কেউ কেউ এতটাই ট্রমাটাইজড হয়ে যায় যে, একসময় তারা বাবা-মা, ভাই-বোনকেও চিনতে
পারে না। ঘুমের মধ্যেও র্যাগিং বা বুলিং তাদের তাড়া করে বেড়ায়। এ এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুলিং বা র্যাগিং দিয়ে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে অসংখ্য শিক্ষার্থীর এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
সময়
বদলেছে। আজকাল বাবা-মায়েরা এ ব্যাপারে সচেতন হচ্ছেন। তবে বুলিংয়ের পরিমাণ সমাজ
থেকে কমে যাচ্ছে, এমনটা বলা যাচ্ছে না। বরং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের দেশে এখনও শিশু-কিশোরদের একটা বড় অংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং
বা র্যাগিংয়ের শিকার হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা, ঘর, কর্মক্ষেত্রÑ সবখানেই
এমন ঘটনা ঘটতে পারে। অনেকের শিক্ষাজীবন এমনকি ব্যক্তিজীবন তছনছ হয়ে যায় এই
বুলিং, র্যাগিংয়ের ফলে। কেউ কেউ হয়তো তা কাটিয়ে উঠতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সারা জীবন মনের মাঝে সেই ক্ষত
বয়ে বেড়ায়। শিক্ষার্থীদের শৈশব বা কৈশোরে থাকবে সুন্দর স্মৃতি যা
তাকে আগামীর পথে হাঁটতে অনুপ্রেরণা দেবে। তা না হয়ে অপ্রীতিকর স্মৃতিগুলো জমতে থাকে কোমল হৃদয়ে। শিশু বা কিশোরদের ক্ষেত্রে যখন ব্যাপারটা ঘটে,
তখন তা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। অনেক
সময় বুলিংয়ের শিকার কেউ কেউ সুইসাইডও করে ফেলে। ফলে মা-বাবা হারাচ্ছেন তাদের প্রিয়
সন্তান।
ভাই হারাচ্ছেন বোন কিংবা বোন ভাইকে। ইউনিসেফের
এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ শিশু বুলিংয়ের শিকার হয় এবং অধিকাংশই পরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় তারা বলেছে, বাংলাদেশে প্রতি চারজন শিক্ষার্থীর একজন সমবয়সিদের
বুলিংয়ের শিকার হয়।
ঢাকাই ছবির সত্তর থেকে আশির দশকের সুপারস্টার ওয়াসিম। তার মেয়ে বুশরা আহমেদ মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্কুলের পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল ২০০৭ সালে। সে সময়ের বিভিন্ন পত্রিকা থেকে জানতে পেরেছিলাম মেয়েটি পরীক্ষার হলে নকলসহ শিক্ষকের হাতে ধরা পড়েছিল। সেই শিক্ষক বুশরাকে বলেছিলেন তার বাবাকে ফোন দেবেন এবং ডেকে এনে সব জানাবেন। আর তখনই লজ্জায় এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলে ১৪ বছরের বুশরা। এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝলাম, শুধু সহপাঠী নয়, শিক্ষক দ্বারাও একটি শিশু বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। ফলে সচেতনতা প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে। বুলিং ও র্যাগিং একটি সামাজিক সমস্যা, যা সবার সচেতনতা এবং যথাসময়ে পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে পারি। আমাদের এ বিষয়ে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। সংশয় নেই, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। তবে তার বেশিরভাগই কাঠামোগত। এখন প্রয়োজন উপরিকাঠামোর উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অবকাঠামোর উন্নয়ন; যা কেবল ইতিবাচক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সম্ভব। একটি দেশ বা সমাজ এগোয় মানুষের ইতিবাচক মূল্যবোধের মাধ্যমে। এ মূল্যবোধ গঠনে রাষ্ট্রেরও যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি ভূমিকা রয়েছে পরিবার ও সমাজের। ফলে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এ বিষয়ে আমাদের আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। শুধু নীতিমালা দিয়েই থেমে থাকলে হবে না, তা কার্যকর বাস্তবায়নেও এগিয়ে আসতে হবে।
- লেখক ও সাংবাদিক
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.