স্মরণ
ছবি : সংগৃহীত
শওকত আলী জীবনভর দুটি বেদনা বহন করে গেছেন। একটা দেশভাগ, অন্যটা সাহিত্যসাধনা। দেশভাগের কারণে তাঁর পরিবারকে জন্মস্থান থেকে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসতে হয়। দেশভাগের নৃশংসতা, বাস্তুচ্যুত হওয়ার বেদনা তিনি জীবনভর বয়ে বেরিয়েছেন। সাহিত্যে, তাঁর নানা সাক্ষাৎকারে এই কথা তিনি জানিয়েছেন পাঠককে, বোধহয় নিজেকেও। একই সঙ্গে তাঁর অন্য আরেকটি বেদনা, যার নাম সৃজন। সেই সৃজনবেদনা এই কথাকারের হাত দিয়ে আমাদের উপহার দিয়েছে ইতিহাস, মানুষ— তার মনস্তত্ত্ব, তার বহু রূপ, তার আনন্দ-বেদনা; সর্বোপুরি গল্পের জমিন। এই গল্পের বিস্তার মধ্যবিত্ত জীবন, উত্তরবঙ্গের পথঘাট, বিভিন্ন পেশাজীবী এবং সদ্য স্বাধীন (বা ভাগ হওয়া) হওয়া একটা দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক চালচিত্র। এই গল্পের বিস্তার একই সঙ্গে কয়েক শত বছর আগে থেকে তাঁর সমমাময়িক কাল পর্যন্ত। এর ফলে দেখা যায় শওকত আলী ইতিহাসকে ধরে একেকটা সময়ের মানুষের চাল-চলন, আচরণ, ধর্মীয় বোধ আঁকতে গিয়ে এঁকেছেন সে সময়ের মানুষের বিস্তারিত। চার শ বছর আগের কাহিনি ধরে তার রচিত ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ পড়লে মনে হবে তিনি বোধহয় সে সময়টায় নিজেই পরিভ্রমণ করেছেন। এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচার কেন বেশি হলো, সে ইতিহাসকে ধরতে গিয়ে তিনি যা রচনা করলেন, তা আসলে মানুষগুলোর প্রাত্যহিকতার নিপুণ চালচিত্রই। ইতিহাসে যা আসে না, মানুষের প্রাত্যহিকতা, আনন্দ-বেদনা ঘিরে দিনলিপি, শওকত আলী সেটুকুর সন্ধান আমাদের উপহার দিয়েছেন তাঁর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসের মাধ্যমে।
এখান থেকে বেরিয়ে তিনি যখন ভ্রমণ করতে লাগলেন এ সময়ের বাংলা। তখন দেখা যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের বিপুল এক জনগোষ্ঠীর দিনচিত্র তার কলমে উঠে আসছে। তিনি নিজে ওপার থেকে এখানে এসে থিতু হয়েছেন, বাবা ছিলেন চিকিৎসক, যুক্ত ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে, শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধে। বাবার থেকে দেশপ্রেমের, মানুষের প্রতি ভালোবাসার জ্ঞানটুকু অর্জন করেন। নাগরিক মানুষ যাদের চেনে না, যারা আসলে বৃহৎ বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের কথা উঠে এসেছে শওকত আলীর গল্পে। তিনি জীবনের শেষদিনগুলো ছাড়া লিখে গেছেন অনবরত। সেই লেখায় একজন ট্রাক ড্রাইভারের রাত, চোরাকারবারির দিনলিপি, পয়সাওয়ালা কামুক ব্যবসায়ীর বাসনার চক্রব্যূহ, একজন নারীর কামুক পুরুষটির প্রতি নৃশংস হয়ে ওঠা— এসব কিছু নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন তার গল্পে। নগরে থাকে না যেসব মানুষ, যারা প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়ছে নানা দিকে, সেসব মানুষের বিস্তারিত চিত্র পাওয়া যায় শওকত আলীর লেখায়।
তাঁর রচনা পাঠে
মনে হয়, তিনি বোধহয়
মানুষগুলোর, সেসব মানুষের ঘিরে
তৈরি হওয়া গল্পটা বলতে
চেয়েছেন। আগেও বলেছি, সেসব
মানুষ কোনোমতেই শহুরে জীবন
ঘিরে থাকা মানুষ নয়। এক্ষেত্রে আমরা যদি
তুলনা করি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান
আজিজুল হক বা সৈয়দ
শামসুল হকের সঙ্গে শওকত
আলীর রচনার। তা
হলে দেখা যাবে প্রথম
তিনজন গল্প বলতে চেয়েছেন, এর
সঙ্গে চেয়েছেন আধুনিক সাহিত্যের
নৈপুণ্যটুকুও দেখাত তাঁদের কলমে। শওকত আলীর ক্ষেত্রে
প্রধান কিন্তু গল্প, মানে কাহিনি। এর সঙ্গে যেটুকু
মাংস লাগে অবয়বটুকু পূর্ণ
করতে, যা যোগ করেছেন। শেষ জীবনে তিনি
লিখতে পারছিলেন না। টিকাটুলির
বাসায় অসুস্থ হয়েই তাঁকে
দিন কাটাতে হচ্ছিল। তখন
তিনি টুকটাক কবিতা লিখতে
চেষ্টা করতেন, কখনও বা
ছড়া। এভাবে একজন
সৃষ্টিশীল মানুষ তার শেষদিন
পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন, সৃজনের ভেতর
থাকতে।
আজ জন্মদিনে অনন্য
এই কথাসাহিত্যিককে শ্রদ্ধা। এ অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক
ইতিহাস বুঝতেও তাঁর রচনা
পাঠ করা প্রয়োজন আমাদের।
লেখক : কবি