× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহার নিয়ে বিটিআরসির এই বিতর্ক সৃষ্টি করা কেন?

রাশেদ মেহেদী

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:৪৫ পিএম

বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহার নিয়ে বিটিআরসির এই বিতর্ক সৃষ্টি করা কেন?

যে যেভাবেই বিতর্ক করুন না কেন ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলার ব্যবহার নিয়ে ইতিহাস লিখতে গেলে মোস্তাফা জব্বারের নামটি আপনাকে উচ্চারণ করতেই হবে। কারণ যে সময়ে বাংলাদেশে ‘কম্পিউটার’ শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই অপরিচিত ছিল সেই ১৯৮৭ সালের ১৬ মে মোস্তাফা জব্বারই বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটারে কম্পোজ করা পত্রিকা ‘আনন্দপত্র’ প্রকাশ করেছিলেন। আর কম্পিউটারের জন্য বাংলা কি-বোর্ডের জনকও তিনি। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘বিজয় বাংলা কি-বোর্ড’ আনুষ্ঠানিকভাবে সবার সামনে নিয়ে এসেছিলেন মোস্তাফা জব্বার।তখন এই কি-বোর্ড সে সময়ে প্রচলিত ম্যাকিন্টোস কম্পিউটারের উপযোগী করে বানানো হয়। একবার ভেবে দেখুন ১৯৮৪ সালের ১০ জানুয়ারি অ্যাপল ইনকরপোরেটেড প্রথম বাজারে ব্যক্তিগত ব্যবহারের ম্যাকিন্টোস কম্পিউটার নিয়ে আসে। সে সময়ে সরকারি উদ্যোগে কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারের কথা পরিকল্পনা দূরে থাক, কারও কল্পনাতেও ছিল না। সে সময়ে আজকের মতো ভার্চুয়াল দুনিয়ার জয়জয়কার ছিল না। ল্যান্ডফোনে একটা কলের সংযোগ পাওয়া ছিল বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। ‘ইন্টারনেট’ শব্দটি সম্ভবত দেশের হাতে গোনা কিছু মানুষ জানতেন। ওই সময়ে বাংলাদেশে বসে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের বাজারে নতুন আসা কম্পিউটার সম্পর্কে জানা কিংবা তার প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে গবেষণা করা যে কারও জন্য দুঃসাধ্য ছিল। কিন্তু একজন ব্যক্তি মোস্তাফা জব্বার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আগ্রহে ম্যাকিন্টোস কম্পিউটার বাজারে আসার মাত্র তিন বছরের মধ্যে সেই কম্পিউটারের জন্য বাংলা কি-বোর্ড তৈরি করেছিলেন! 

১৯৯৩ সালে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ কম্পিউটারের জন্যও বিজয় কি-বোর্ড ও সফটওয়্যার প্রকাশ করেন মোস্তাফা জব্বার। এখানে বলে রাখি, মাইক্রোসফট উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের ব্যক্তিগত কম্পিউটার ১৯৮৫ সালের ২০ নভেম্বর বাজারে নিয়ে আসে। তবে শুরুতে প্রায় তিন-চার বছর এটি পরীক্ষামূলকই রাখে মাইক্রোসফট। যে কারণে উইন্ডোজ কম্পিউটার বড় আকারে বাজারে আসে ১৯৮৮ সালের শেষের দিক থেকে। প্রথম দিকের অ্যাপল-ম্যাকিন্টোস কম্পিউটারে কাজ করার বড় সমস্যা ছিল এটি ব্যবহার করতে হতো কোড ব্যবহার করে। প্রতিটি অপশনের জন্য ব্যবহারকারীকে পৃথক কোড মনে রাখতে হতো। কিন্তু উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম গ্রাফিক্যাল সিস্টেমের মাধ্যমে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করল। সঙ্গে গ্রাফিক্স ডিসপ্লেও যুক্ত হলো। ফলে কোড মনে রাখার কঠিন কাজটি থেকে কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা মুক্তি পেলেন। যে কারণে ১৯৮৮ সালের পর এক বছরের মধ্যেই উইন্ডোজ কম্পিউটার জনপ্রিয়তায় ম্যাকিন্টোসকে ছাড়িয়ে যায়। আর বাংলাদেশে উইন্ডোজ কম্পিউটার আসে ১৯৯২ সালে। দেশে আসার এক বছরের মধ্যেই এই নতুন এবং এক ধাপ এগিয়ে থাকা উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের জন্যও বাংলা কি-বোর্ড প্রকাশ করলেন সেই মোস্তাফা জব্বারই। 

উপরের যে ইতিহাস তুলে ধরলাম, সেটা কমবেশি সবারই জানা। কিন্তু সেই ইতিহাস সামনে নিয়ে আসার মূল কারণ হচ্ছে গত ১৩ জানুয়ারি বিটিআরসির একটা নির্দেশনার কারণে। বিটিআরসি ওই নির্দেশনায় বাংলাদেশে বাজারজাত সব অ্যান্ডয়েড স্মার্টফোনে বিজয় অ্যাপের এপিকে (অ্যানড্রয়েড প্যাকেজ কিট) প্রি-ইনস্টলড রাখার বাধ্যকতা দিয়েছে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন করা প্রতিষ্ঠানকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিটিআরসির এই নির্দেশনা নতুন কিছু নয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালককে প্রধান করে গঠিত একটি কমিটি বাংলাদেশে বাজারজাত করা অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোনে বিজয় অ্যাপের এপিকে প্রি-ইনস্টল করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত সে সময় থেকেই বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ করে এত বছর পর বিটিআরসি কেন এই নির্দেশনা জারি করল সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। 

বিটিআরসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নির্দেশনাটি কার্যকর হবে এটি জারির দিন থেকেই। আর তিন কার্যদিবসের মধ্যে হ্যান্ডসেট উৎপাদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওই এপিকে সংগ্রহ করতে হবে। এপিকে বিনা মূল্যে দেওয়া হবে। নির্দেশনার দিকে তাকালে দেখা যায় খুবই অপরিপক্বভাবে এই নির্দেশনাটি জারি করা হয়েছে। নির্দেশনাটি পড়লে মনে হয় আগে কখনও বাংলাদেশে অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোন উৎপাদন হয়নি, প্রথমবারের মতো উৎপাদন শুরু হতে যাচ্ছে! আমরা সবাই জানি, ২০১৭ সাল থেকেই বাংলাদেশে বিশ্বখ্যাত স্যামসাং ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোন উৎপাদন শুরু করেছে। এরপর আরও কয়েকটি বৈশ্বিক ও স্থানীয় ব্র্যান্ড বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করেছে। এ লেখা যখন লিখছি তখন চীনের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড শাওমি ২০২১ সালে গাজীপুরে স্থাপন করা কারখানাটি বন্ধ করে দিচ্ছে বলেও খবর এসেছে। দেশে স্মার্টফোন উৎপাদন শুরু হওয়ার প্রায় ছয় বছর পর বিটিআরসি তিন দিনের মধ্যে এপিকে সংগ্রহ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে নির্দেশনা জারি করল! বাজারে থাকা হ্যান্ডসেটের কথা না হয় বাদ দিলাম, উৎপাদন পর্যায়ে থাকা হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে কী হবে? কারণ বর্তমানে যে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা, সেখানে উৎপাদনের শুরু থেকেই অপরেটিং সিস্টেম ইনস্টল করার সব প্রস্তুতি নিয়ে উৎপাদন শুরু করতে হয়। মাঝপথে নতুন করে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করা যায় না। আবার স্যামসাং, ওয়ান প্লাস, অপ্পো, ভিভো কিংবা এ ধরনের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলো নিজেদের মতো করে কাস্টমাইজড অ্যানড্রয়েডের সংস্করণ ব্যবহার করে। এই কাস্টমাইজড পলিসি তাদের কেন্দ্রীয় ‘রিসার্চ ও উন্নয়ন’ বিভাগ অনুমোদন দেয়। নতুন কোনো অ্যাপ ইনবিল্ট করতে হলে অবশ্যই সেটা কেন্দ্রীয়ভাবে অনুমোদন নিতে হবে ওই ব্র্যান্ডের স্থানীয় উৎপাদকদের। ফলে বিটিআরসির নির্দেশনামতো তিন কার্যদিবসের মধ্যে বিনা মূল্যে এপিকে সংগ্রহ করে তা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করা উৎপাদকদের জন্যও বাস্তবসম্মত নয়।

অনেকেই বিটিআরসির নির্দেশনাকে উদ্ধৃত করে বলছেন, বিজয়ের মালিকানা যেহেতু বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের প্রতিষ্ঠানের, সে কারণে শুধু বিজয় ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়ে একই ধরনের অন্য সফটওয়্যার বা অ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করে দিচ্ছে। নির্দেশনায় কিন্তু তা বলা হয়নি। উৎপাদকদের বিজয় এপিকে প্রি-ইনস্টলড রাখতে হবে। কিন্তু ব্যবহারকারী চাইলে অন্য যেকোনো সফটওয়্যার যেমন রিদমিক কি-বোর্ড, মায়া কি-বোর্ড বা এ ধরনের বাংলা কি-বোর্ড ব্যবহার করতেই পারেন। সরকারিভাবে স্ট্যান্ডার্ড কি-বোর্ড ব্যবহারে সাধারণ ব্যবহারকারীদের কিন্তু বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়নি। এ বিষয়টিও বিটিআরসির নির্দেশনায় পরিষ্কার করা উচিত ছিল, কিন্তু করা হয়নি। বিটিআরসির অপরিপক্ব, অস্বচ্ছ নির্দেশনার সমালোচনা না করে এখন কম্পিউটারে বাংলা কি-বোর্ডের উদ্ভাবককে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ, সবার ধারণা মন্ত্রীর নির্দেশেই বিটিআরসি এই নির্দেশনা জারি করেছে। আমি এ বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি স্পষ্ট করেই আমাকে জানিয়েছেন, এ নির্দেশনা জারির আগে বিটিআরসির কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারাও জানিয়েছেন, এ নির্দেশনার আগে বিটিআরসি তাদের সঙ্গেও আলোচনা করেনি। অতএব বিটিআরসিকে প্রশ্ন করাই যেতে পারে, কেন তারা হুট করে এ ধরনের নির্দেশনা জারির মাধ্যমে অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিল? 

বাংলাদেশে কিন্তু কম্পিউটারে শতভাগ মানুষকেই বাংলা অক্ষরে লেখা শিখিয়েছে বিজয়। বাংলাদেশে যতগুলো বাংলা ফন্ট আছে, সেগুলোর অধিকাংশই বিজয় সফটওয়্যার থেকে আসা কিংবা বিজয়কে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে উৎপাদন করা। একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। ২০০৪ সালে প্রচলিত বিজয় কি-বোর্ডের দুটি বোতাম দুই দিকে স্থানান্তর করে (এইচ বোতাম এফ বোতামে এবং এফ বোতাম এবং এইচ বোতামে পরিবর্তন করে) ‘বিডিএস-১৭৩৮-২০০৪’ নামে একটি কি-বোর্ড স্ট্যান্ডার্ড করা হয়েছিল। প্রথম সরকারি কম্পিউটার কি-বোর্ড স্ট্যান্ডার্ড স্থাপন করা হয়েছিল মূলত বিজয়কেই। ২০১৭ সালে স্মার্টফোনের জন্য গঠিত ১৪ সদস্যের কমিটির প্রতিবেদনেও ২০০৪ সালের বিডিএস-১৭৩৮-২০০৪ কে হুবহু বিজয় কি-বোর্ডকে স্ট্যান্ডার্ড করা হয় ‘বিডিএস-১৭৩৮-২০১৮’ নামে। কারণ, দেখা যায় বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ কম্পিউটার ব্যবহারকারী হুবহু বিজয় ব্যবহার করছে। আবার বিজয়ের সুতন্নিএমজে আস্কি কোডের নাম বাস্কি নাম দিয়ে ‘বিডিএস ১৯৩৫’ করা হয়েছে। অতএব বিতর্ক আপনি করতেই পারেন। আপনার পছন্দমতো যেকোনো সফটওয়্যার আপনার স্মার্টফোনে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন কম্পিউটারে কিংবা স্মার্টফোনে বাংলায় লেখার জন্য যে ভিত্তিভূমি সেই বিজয়ের ওপরই আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আজ এবং আগামীকালও। 

রাশেদ মেহেদী, টেকনোলজি এডিটর, প্রতিদিনের বাংলাদেশ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা