× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

৯৯৯-এ নারীর অভিযোগ ও অধিকারের সমতা

খুশী কবির

প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:২৮ পিএম

আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৩১ পিএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর উন্নয়ন কিংবা ক্ষমতায়নের কথা বললে বলতে হবে এর দুটো দিক আছে। এক. সামাজিক সূচকে আমরা অনেক এগিয়েছি। গড় আয়ু বেড়েছে। একাত্তর সালে নারীর গড় আয়ু ছিল ৫০-এর কোঠায়, সেটা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১-এ। তখন নারীর অবস্থা কতটা নাজুক ছিল তা এ পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে, যা আগে অনেক কম ছিল কিংবা সীমিত ছিল। কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে এই পরিবর্তনটা ইতিবাচক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অভিগম্যতা বেড়েছে। নারী অনেক জায়গায় যেতে পারছে, যে সুযোগ আগে কম ছিল। বাহাত্তর সালের কথা যদি বলি, তখনও নারীদের রাস্তাঘাটে ততটা দেখা যেত না, যতটা এখন দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের নারীর উন্নয়ন, বিশ্বস্বীকৃত এবং প্রশংসিত। তবে নারীর অগ্রগতির যে হার তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এমন নয়। কিন্তু নারী-পুরুষে বৈষম্যের হার অনেক কমেছে এবং এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা বেশ দৃশ্যমান। নিঃসন্দেহে এ চিত্র অনেক বড় অগ্রগতির সাক্ষ্যবহ।

নারীর এত অর্জনের মাঝেও তার নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। একই সঙ্গে এও সত্য, দেশে নির্যাতনের মাত্রাও কমছে না। বরং, ক্ষেত্রবিশেষে নারী নির্যাতনের ধরন এবং তীব্রতা অনেক বেড়েছে। ২০২২ ছিল নারীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বছর। সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতন, নারীর ওপর সহিংসতা ও ধর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। এমনকি বেশ কয়েকটি গবেষণা পর্যবেক্ষণের সমীক্ষা থেকেও নারীর নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কাজনক চিত্র দেখতে পেয়েছি।

ধর্ষণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন হলেও ধর্ষণ থামেনি। সামাজিক মূল্যবোধ এতই নিচে নেমেছে যে, প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষিত হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক, ৯৯৯ অভিযোগ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ৯৯৯-এ নারী নির্যাতনের অভিযোগ বেড়েছে। নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নিজ ঘরে। পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ওই বছরের আগস্ট পর্যন্ত এ ধরনের কল এসেছে ১৩ হাজার ৪১৬টি, যেখানে ২০২১ সালে পুরো বছর মিলে এমন কলের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ১৬৯। জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে যে ধরনের ফোন আসে, সেই তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়Ñ নারীর ওপর নিপীড়ন আর সহিংসতার অভিযোগ জানাতে বা সাহায্য চেয়ে ফোনকলের সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে অনেক বেড়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন বা তাদের সমতা কিংবা এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বাধা এ পারিবারিক আইন। আমাদের দাবি, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা হোক। তাহলে তা হবে সবার জন্য সমান এবং নারীর সমতা একেবারে নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত করবে। এখন যেহেতু ডিজিটাল যুগ, তাই সাইবার ক্রাইমও বেড়েছে। বিশেষত উঠতি তরুণদের মধ্যে নারীর ওপর আক্রমণ আর বিদ্বেষ বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু অসঙ্গতির কারণে। ঊর্ধ্বমুখী এই হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নারী নির্যাতন-হয়রানি অনেক বেড়েছে, যদিও আমরা আগের থেকে অনেক এগিয়েছি। কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। আমাদের অনেক দ্রুত এগোতে হবে সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। সমতা শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, তা আনতে হবে সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রেও।

মানুষ অনেক উগ্র হয়েছে। সামাজিক প্রতিরোধও এখন আর কেউ তেমনভাবে করতে চায় না। সামাজিক অবক্ষয়ের নানা চিত্র উঠে আসছে। এটা একটা নেতিবাচক দিক। বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে যখন বেশ আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তখনও দেশে নারীর শ্রমের মজুরি কম দেওয়া হচ্ছে। যদিও আইএলও কনভেনশনে আছে সম-অধিকারের কথা, সম-মজুরির কথা। শুধু আইএলও কনভেনশন কেন, বাংলাদেশের আইনেও কিন্তু মজুরি সমান এবং ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের ছুটি তো মেলেই না, উল্টো ছাঁটাইয়ের হুমকি আসে। অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহিত হলে কোনো কর্মীকে নিতে চায় না। অবশ্য এ সমস্যাটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান নয়, অন্য অনেক দেশেও এ সমস্যা আছে। সামাজিক পরিসরে নারীর প্রতি প্রত্যেকের মনোভাব ও অন্য বিভিন্ন সামাজিক সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নারীর মর্যাদা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি। এ জন্য নারীর নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর সবচেয়ে প্রমাণ মেলে ৯৯৯-এ অভিযোগের হার বেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যানে। আমাদের আইন যা-ই থাকুক না কেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সবার মানসিকতার পরিবর্তন সমভাবে না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না, আমরা অনেক পিছিয়েই থাকব।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর আইন আছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই হয় না। ভুক্তভোগী নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেভাবে তাদের অশোভন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বিশেষ করে ধর্ষণ মামলায়, তা প্রত্যাশিত নয়। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, সমাজের অন্য অনেকেই কি নারীকে সেভাবে মর্যাদা দেন? সমাজপতিরা কোর্টের বাইরে যেভাবে সালিশ করেন তাতেও নারীর মর্যাদার হানি ঘটছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে নারীর মর্যাদাও সামাজিক পরিসরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজে নারীকে নানাভাবে অসম্মানিত হতে হচ্ছে। তা ছাড়া আইন প্রণয়নের পর সেই আইন সময়োপযোগী করার পদ্ধতি নিয়েও ভাবতে হয়। কারণ অনেক সময় অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর বের করার অভিনব পদ্ধতি খুঁজে বের করে নেয়। তাই কঠোর আইন থাকার পরও অনেকে পার পেয়ে যায় ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে। দেখা যাচ্ছে ধর্ষক ধরা পড়ছে কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকর বেয়ে তারা বেরও হয়ে যাচ্ছে; যে কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমছে না। এ ব্যাপারে আরও গভীর নজর দেওয়া জরুরি।

নারী নির্যাতন রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিকতার ঘাটতি তাও সর্বাংশে সঠিক নয়।  কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে তা দেখা যায় না এ-ও নয়। অর্থাৎ এ ব্যাপারে ঢালাও অভিযোগ জানানো ঠিক নয়। ৯৯৯-এ অভিযোগের মাধ্যমে নারী এখন কিছুটা হলেও প্রতিকারের সুযোগ পাচ্ছে। নিকট অতীতে এক নারী শিক্ষার্থী মাদ্রাসাশিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়। মেয়ের অভিভাবক ভাবছিলেন মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিলে হয়তো লজ্জা ধামাচাপা দেওয়া যাবে। মেয়েটা কিন্তু নিজেই প্রতিবাদ করেছে এবং ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। স্বস্তির বিষয়, প্রতিকারও পেয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। কাজেই দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা আছেন এবং তাদের সংখ্যাই বেশি। কিছু মানুষের মানসিকতারও পরিবর্তন হয়েছে। এত কিছুর পরও কিন্তু নারীর আতঙ্ক কমেনি। শহরে কিছুটা হলেও চলাচলে নারী স্বাধীনতা পায়। এই পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হতে শুরু করেছে। গ্রামের মেয়েদের কথা ভেবে দেখা যাক। তারা ভয় পায়। তাদের অভিভাবকরা ভয় পায়। মেয়েটা কি স্কুল-কলেজ শেষ করে বাসায় নিরাপদে ফিরতে পারবেএ প্রশ্নটা তাদের সর্বক্ষণ তাড়া করে। এ জায়গাটিতে পরিবর্তন আসা জরুরি সামগ্রিক কল্যাণের প্রয়োজনে।

নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় সব সূচকেই নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কার মেয়েরা বেশ ভালো অবস্থানে আছে। অথচ আর্থিক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে পাকিস্তান, ভারত কিংবা আফগানিস্তানের মেয়েরা বাংলাদেশের মেয়েদের চেয়ে পিছিয়ে আছে। নেপালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাম রাজনৈতিক দল ক্ষমতা নেয়ার বসার পর সেখানকার আইনে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে নারীর মর্যাদা বেড়েছে, সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমাদের উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই সম অধিকার দেওয়া আছে। পারিবারিক আইনে আছে উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ আর আছে তালাকের বিষয়গুলো। একজন নারী অধিকার কর্মী হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও পরিবর্তন প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেশিক্ষার্থীর চেয়ে মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু সে তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। এ ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধাগুলো দূর করতে হবে। ঘরের বাইরে নারীর কাজ করা নিয়ে সমাজে যেসব অপপ্রচার আছে, তা বন্ধ করতে হবে। বাইরে কাজ করার ক্ষেত্রে কর্মস্থল ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। 


লেখক : সমন্বয়ক, নিজেরা করি

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা