মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:০৪ এএম
অলঙ্করন : প্রবা
আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াকে কেন্দ্র করে আমরা সমালোচনা, কটাক্ষ করে থাকি। জনগণ যদি প্রার্থীকে ভোটই দিতে না পারে, তাহলে ওই প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা যুক্তিযুক্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা, সিটি করপোরেশন এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা এক এবং অভিন্নই বলা যায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে সমালোচনা নাগরিক অধিকারের বাইরের বিষয় নয়। আমরা অভ্যস্তও হয়ে পড়েছি এবং মেনেও নিয়েছি, ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান অনিরপেক্ষই হবে । কিন্তু এমনটি কাম্য নয়।
অভিন্ন সংস্কৃতি বিরাজ
করছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র
ভারতেও। অভিযোগ আছে, বিজেপির
শাসনামল অতীতের সব রেকর্ড
ভেঙেছে। গত নভেম্বরে
ত্রিপুরা রাজ্যের পুরসভা নির্বাচনে
রাজ্যের এবং কেন্দ্রের ক্ষমতায়
থাকা বিজেপি নির্বাচনকে চরম
প্রহসনে পরিণত করেছে এ
অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে উঠেছে। বিরোধী দলের প্রার্থীদের
বলপ্রয়োগে মনোনয়নপত্র দাখিল
করতে না পারার কারণে
১২২ জন বিজেপি প্রার্থী
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত
হয়েছেন। ওই নির্বাচনের
পূর্বাপর নির্বাচনের জবরদখল, অনিয়ম, আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীকে ব্যবহার করে একতরফা
নির্বাচন সম্পন্ন করেছে রাজ্য
সরকার তাও শোনা গেছে। ‘গুন্ডা’ বাহিনীর দাপট
লক্ষ করা গেছে। বিরোধীরা
অভিযোগ জানালে রাজ্যের এক
মন্ত্রী বলেন, ‘চোপ! সাজানো
কথা বলতে এসেছো! বিজেপির গুন্ডা
বাহিনী কিছু করলে তোমরা
এখানে থাকতে পারতে?’
নির্বাচনের শেষে সিপিএম
পুরসভা ভোটকে ‘প্রহসন’ আখ্যা
দিয়েছে। অপরদিকে বিজেপিবিরোধী
ভোট খণ্ডিত করতে ত্রিপুরা
রাজ্যে আগমন করেছে তৃণমূল
কংগ্রেস। স্মরণ করা
যায়,
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বিজেপির
ন্যায় একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল
শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। আগরতলা
পুর-নিগমের
ভোট বাতিলের দাবি তুলেছে
তৃণমূল কংগ্রেসও। ওদিকে
বিজেপি জোরের সঙ্গে বলেছে, বিরোধীদের
প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা
করে মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট
দিয়েছেন। এমন দাবি
আমাদের দেশেও বিভিন্ন ঘটনার
পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সরকারগুলো করেছে। প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বাড়ায়। ভোটাধিকারও মানবাধিকার। দেশে-বিদেশে
নানা মহলে এ
কথা আমরা এ
পর্যন্ত বহুবার শুনেছি। নির্বাচন প্রক্রিয়া যত স্বচ্ছ
হবে, গণতন্ত্র ততই
মজবুত হবে। রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি সামগ্রিক কল্যাণের পথ প্রশস্ত করে।
কিন্তু নিকট অতীতে
অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ
ভারতে যা পরিলক্ষিত হয়েছে
তা প্রশ্নবোধক। পুর-নিগম, পুর
পরিষদ ও নগর পঞ্চায়েত
মিলে ত্রিপুরার ৩৩৬টি
আসনের নির্বাচনে ১১২টি
আসনে বিজেপি প্রার্থী বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্বেই নির্বাচন
কমিশন কর্তৃক জয়ী হওয়ার
ফলে নির্বাচন হয়েছে ২২৪টি
আসনে। রাজ্য নির্বাচন
কমিশনের প্রদত্ত হিসাবে ভোট
পড়েছে ৭৫%-এর বেশি। রাজ্যের পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনসংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের মহলগুলোর ইতিবাচক
ভূমিকায় বড় কোনো সংঘর্ষ
হয়নি।
২৫ নভেম্বর ওই
রাজ্যের নির্বাচনের পর
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র
চৌধুরী নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দিনেদুপুরে
গণতন্ত্রের ওপর অমাবস্যা নামিয়ে
এনেছে বিজেপি জোট সরকার। সরাসরি কেন্দ্রীয় নেতাদের
নির্দেশে এই গুন্ডামি হয়েছে। কেউ কোনো সুরক্ষার
বন্দোবস্ত করেনি। আমরা
সুপ্রিমকোর্টে যাব, জনতার দরবারেও
এই ছবি তুলে ধরব।’ প্রদেশ কংগ্রেস
সভাপতি বীরজিৎ সিংহের বক্তব্য
কিছুটা ব্যতিক্রমী। তিনি
বলেছেন, ‘একমাত্র
কৈলাসহরে মানুষের প্রতিরোধের মুখে
বিজেপি বিশেষ কিছু করতে
পারেনি। এ ছাড়া সারা
ত্রিপুরায় গণতন্ত্র হত্যার তাণ্ডব
চলেছে। শাসকদলের আক্রমণের
শিকার প্রধানত সিপিএম এবং
বামফ্রন্ট। তবে বাদ
পড়েনি তৃণমূল কংগ্রেসও।’ নির্বাচনে
অনিয়মের প্রতিবাদে এবং
পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়
আগরতলার পশ্চিম থানা ঘেরাও
করে সিপিএমের কর্মী, সমর্থকরা। ওই
ঘেরাও আন্দোলনে তৃণমূলের নেতা
সুবল ভৌমিকও অংশ নেন। কিন্তু পুলিশ তাদের
বক্তব্য না শুনে তাদের
তুলে নিয়ে যায়। ত্রিপুরা
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র নবেন্দু
ভট্টাচার্য দাবি করেছেন, ‘প্ররোচনা
ও ষড়যন্ত্র ছিল। বিরোধীরা
নানা কথা বলে গিয়েছেন। কিন্তু তাদের সমস্ত
প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে মানুষ
শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট দিয়েছে।’
রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অরিন্দম নাথ
বলেছেন, ‘বেশকিছু
অভিযোগ এসেছে। কিছু
ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া
হচ্ছে।’ অভিযোগের তীর
যে শাসকদলের বিরুদ্ধে, সেটা মেনে
নিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। এই
নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে
বিজেপির আঁতাতের কথাও শোনা
গেছে।
সামনে উত্তর প্রদেশের
নির্বাচন। ভারতের সবচেয়ে
বৃহৎ প্রদেশ ওটি। অতীতের
পরিসংখ্যান অনুযায়ী উত্তর প্রদেশের
বিধান সভার নির্বাচনে জয়ীরাই
কেন্দ্রের ক্ষমতা লাভ করে
এসেছে। ওই বিবেচনাকে
আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বছরব্যাপী
কৃষক আন্দোলনের সব
দাবি মেনে নিয়েছে, বাস্তবতা হচ্ছে
বাধ্য হয়েছেন। কৃষক
আন্দোলনে বিজেপির জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে। এটিই বিজেপির
পতন ডেকে আনে কি
না,
সেটাও আগামীতে পরিষ্কার হয়ে
যাবে। হারানো জনপ্রিয়তা
ফিরে পাওয়ার অভিপ্রায়ে এবং
উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের মুখে
বিজেপি সরকার কৃষকদের লাগাতার
আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করেছে। এতে শেষরক্ষা হয়
কি না আসন্ন উত্তর
প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচনে
প্রমাণ পাওয়া যাবে। অথচ
কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে
বামপন্থিদের অবস্থান শুরু থেকে
লক্ষ করা গেলেও পশ্চিম
বাংলার শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস
টুঁশব্দটি করেনি। বিপরীতে
কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে
সরকারের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। পশ্চিম বাংলায় বামপন্থিদের
কৃষক আন্দোলনের সংহতি
সমাবেশ ও মিছিলে পুলিশ
দিয়ে বৈরী ভূমিকা পালনের
নজির রেখেছে রাজ্যের তৃণমূল
কংগ্রেস সরকার। এসব
কারণে ঘাসফুল পদ্মফুলকে বিরোধীরা
বিজেমূল আখ্যা দিয়েছে, অর্থাৎ বিজেপি
এবং তৃণমূলের রহস্যজোট নিয়ে
নানা কথা শোনা গেছে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নতুন করে বলার কিছু নেই। রাষ্ট্রটি জন্ম থেকে এযাবৎ সামরিক আমলাতন্ত্রেরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলা যায়। গণতন্ত্র সেখানে অতীতেও ছিল না, আজও নেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি উপমহাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির ওপর ভর করে আছে। ওই সংস্কৃতি বদলাতে হলে ঔপনিবেশিক কালাকানুন, আমলাতন্ত্র এবং রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এটি ওপর থেকে আসবে না। জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই আসবে। নাগরিকের অধিকার সুরক্ষায় সব দেশেই জনগণের সচেতনতা ও গঠনমূলক ভূমিকা প্রয়োজন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত