× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জরুরি প্রয়োজন সামাজিক মুক্তি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:৪৫ এএম

অলঙ্করন : প্রবা

অলঙ্করন : প্রবা

দেশে যে তরুণরা আজ পরস্পরকে খুন-জখম করছে, আসক্ত হচ্ছে নানাবিধ মাদকে, একসময়ে তারা যেমন মুক্তিযুদ্ধে ছিল, তেমনি পূর্ববর্তী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও ছিল। রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছে, কিন্তু জয়ের প্রমাণ তো দেখতে পাই না, দেখতে পাই মাতৃভাষা কেবলই কোণঠাসা হচ্ছে। শহীদ দিবসের প্রভাতফেরিকে আদর-আপ্যায়ন করে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মধ্যরাতে, সকালের সেই অরুণ আলো মলিন হয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারের কাছে তার আত্মসমর্পণ ঘটেছে। পুঁজিবাদের অপ্রতিরোধ্য তৎপরতা যে সর্বগ্রাসী হতে চলেছে, এ হচ্ছে তারই একটি নিদর্শন। একুশ ছিল রাষ্ট্রবিরোধী এক অভ্যুত্থান, রাষ্ট্র তাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেবার অছিলায় আটক করে ফেলেছে। ওদিকে উচ্চ আদালতে বাংলা নেই, ঠিকমতো নেই উচ্চশিক্ষাতেও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে হবে শুনলে শিক্ষার্থীদের মুখ শুকায়, অভিভাবকরা প্রমাদ গোনেন। স্মার্ট ছেলেমেয়েরা বাংলা বলতে অস্বস্তিবোধ করে, শিক্ষিত বয়স্করাও বাংলা বলেন ইংরেজির সঙ্গে মিশিয়ে। প্রমাণ দেয় যে তারা পিছিয়ে নেই। এই অস্বাভাবিকতাই এখন নতুন স্বাভাবিকতা

একুশে ফেব্রুয়ারির পরিচয় কেন বাংলা ফাল্গুন মাসের তারিখ দিয়ে হবে না, এ নিয়ে বিজ্ঞ মহলে প্রশ্ন উঠেছিল। ফাল্গুন তার উপেক্ষার উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়েছে, নীরবে। পহেলা ফাল্গুন এখন বেশ ভালোই সাড়া জাগায়। সঙ্গে থাকে ভালোবাসা দিবস। পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস, এই দুইয়ের কারও সঙ্গেই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলনের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই। উল্টো বিরোধ আছে। পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস উদ্‌যাপনের ভেতর দিয়ে তরুণরা তাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য উদ্দীপিত হয় না। তাদের আগ্রহটা মোটেই দেশপ্রেমিক নয়, একান্তই ব্যক্তিগত। ভালোবাসা খুঁজতে বের হয়ে তারা প্রাইভেট হয়ে যায়, পাবলিককে দূরে সরিয়ে দিয়ে। পেছনে তৎপরতা থাকে বাণিজ্যের। ফুল, পোশাক, উপহার, রঙ, এসবের কেনাবেচা বাড়ে। সমস্ত তৎপরতা নির্ভেজালরূপে পুঁজিবাদী এবং সে কারণে অবশ্যই একুশের চেতনার বিরোধী। আর একুশের চেতনারই তো বিকশিত রূপ হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও যে বাণিজ্যের প্রকোপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে, এমনও নয়।

তিন ধারার শিক্ষা সগৌরবে বহাল রয়েছে এবং আঘাত যা আসছে তা মূল যে ধারার, বাংলা ধারার ওপরেই বেশি। সেই ধারার পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক, পরীক্ষাব্যবস্থা, এসব নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এবং প্রায় কোনোটাই শিক্ষার্থীদের উপকারে আসছে না। মাধ্যমিক স্তরে ইংলিশ ভার্সন চালু হয়েছে, তাকে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ রয়েছে। নিম্নবিত্ত অভিভাবকরা হয়তো খুশিই হবেন, ভাববেন তাদের সন্তানরা আর বঞ্চনার শিকার হবে না, তারাও ইংরেজিতে শিক্ষিত হবার অধিকার পাবে। করোনাকালে সব স্কুল বন্ধ হলেও কওমি মাদ্রাসা কিন্তু বন্ধ হয়নি। সেখানে ভর্তির সংখ্যা বেড়েছিল। আগামীতে নিম্নধ্যবিত্তের যে অংশটি গরিব হয়ে যাবে, তাদের ছেলেমেয়েরা কওমি মাদ্রাসার দিকেই ঝুঁকবে। তাতে দেশের ভালো হবে এমন আশা দুরাশা।

প্রসঙ্গত বলা যায় শিক্ষক নির্যাতনের বিষয়ে। শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা কম ঘটেনি। আলাদা স্থানে ও সময়ে শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তা বিচ্ছিন্ন নয়। বরং সংলগ্নতা আছে। আমরা যে সাংস্কৃতিক ও নৈতিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছি, এসব ঘটনা তারই লক্ষণ। শিক্ষার প্রতি আগে মানুষের আগ্রহ ছিল। সেই সূত্রে শিক্ষকদের সম্মান করা হতো। এখন তা কমে গেছে। কেননা, এখন টাকা আর রাজনৈতিক জোরেই অনেক কিছু মিলে যাচ্ছে। যে কারণে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। এর সমান্তরালে শিক্ষকদের প্রতিও আগ্রহ কমছে। শিক্ষকদের প্রতি এ ধরনের আচরণ আগে ছিল অকল্পনীয়। শিক্ষকদের ওপর নির্যাতনের এই যে ঘটনা, তা সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধর্চচার সংকট থেকে উদ্ভূত।

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি চর্চার ঘাটতি দীর্ঘ। মূল্যবোধের প্রতি উদাসীনতা আছে। দুর্বত্তদের আধিক্য সমাজে বাড়ছে, শিক্ষক নির্যাতনের এই সামাজিক সমস্যা এসেছে সেখান থেকেই। যে উন্নয়নের কথা আমরা শুনছি তা হচ্ছে মুনাফার, জ্ঞানের উৎকর্ষ নয়। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন কিছু নয়। সবার আগে আমাদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উৎসাহিত করতে হবে। স্বাধীনতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মুক্তি এসেছে। কিন্তু আমাদের জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন সামাজিক মুক্তি। রাষ্ট্রীয় মুক্তি আর সামাজিক মুক্তি এক নয়। অনেক কিছুই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মতো হয়ে গেছে, যা মানুষরে জন্য কল্যাণকর নয়, সেটার পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। এ জন্য প্রয়োজনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা যেতে পারে। এমন সমাজ কাম্য নয়, যেখানে বলবানরা শক্তিহীনের ওপর নির্যাতন করবে। যারা শিক্ষক নির্যাতন করছে, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিজেদের শক্তিশালী মনে করছে। তারা তাদের ক্ষমতা শিক্ষকের ওপর প্রয়োগ করছে। যেভাবে সবল দুর্বলের ওপর লাঞ্ছনা করে। সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে সমাজে এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে।

পৃথিবী যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। দুর্ঘটনাও নয়। অনিবার্যভাবেই তা ঘটে চলেছে। সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিতদের ভেতর বিভাজনটা অতিপুরাতন। একালে বিভাজনটা সর্বগ্রাসী ও সর্বত্রবিস্তারী হয়েছে, এই যা। ভাগটা ওপরের ও নিচের। ওপরে রয়েছে সুবিধাভোগী অল্প কিছু মানুষ, নিচে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ, যারা শ্রম দেয় এবং যাদের শ্রমের ফল অপহরণ করেই ওপরের মানুষগুলো তরতাজা হয়। লেখক জনাথন সুইফট তার গালিভার্স ট্রাভেলস বইতে আজব কয়েকটি দেশের কল্পকাহিনি লিখেছিলেন। দেশগুলোর একটিতে শাসকরা থাকে উড়ন্ত এক দ্বীপে, নিচে বিস্তীর্ণ এক মহাদেশ, সেখানে বসবাস প্রজাদের। প্রজারা মেহনত করে, তাদের উৎপাদিত খাদ্য যন্ত্রের সাহায্যে তুলে নেওয়া হয় উড়ন্ত দ্বীপে; সুযোগসুবিধাভোগী রাজা, তার মন্ত্রী ও পারিষদদের ভোগের জন্য। প্রজাদের বিস্তর অভিযোগ আছে। সেগুলো শোনার ব্যবস্থাও রয়েছে। উড়ন্ত দ্বীপটি যখন যেখানে যায়, সেখানকার মানুষদের সুবিধার জন্য ওপর থেকে সুতো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। প্রজারা তাতে ইচ্ছা করলে মনের সুখে নিজেদের অভিযোগগুলো কাগজে লিখে সুতোতে বেঁধে দিতে পারে। কিন্তু সেই কাগজ কেউ কখনো পড়ে বলে জানা যায়নি। তবে প্রজারা যদি ভুল করে কোথাও বিদ্রোহ করে বসে তবে তার জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা সে রাজত্বে রয়েছে। উড়ন্ত দ্বীপটি বিদ্রোহীদের এলাকায় ওপরে এসে উপস্থিত হয়; ফলে সূর্যের কিরণ ও বৃষ্টিপাত, দুটো থেকেই নিচের বিদ্রোহীরা বঞ্চিত হয়ে অচিরেই নাকে খত দেয়। বিদ্রোহ দমনের আরেকটি পদ্ধতি উড়ন্ত দ্বীপ থেকে বড় বড় পাথর নিচের মানুষদের লক্ষ করে নিক্ষেপ করা।

নিচের মানুষদের ওপর ওপরওয়ালাদের এই শাসন-শোষণের ছবিটি আঁকা হয়েছিল বেশ আগে, ১৭২৬ সালে। এর প্রায় ২০০ বছর পরে ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নাটক লিখেছিলেন মুক্তধারা নামে। সেটাও ওই ওপর-নিচ সম্পর্ক নিয়েই। ওপরে থাকেন উত্তরকূটের রাজা-মাহারাজারা, নিচে বসবাস শিবতরাইয়ের প্রজাদের। প্রজারা নিয়মিত খাজনা দেয়। তবে পরপর দু’বছর দুর্ভিক্ষ হওয়ায় খাজনা ঠিকমতো শোধ করতে পারেনি। শাস্তি হিসেবে ওপর থেকে নিচে বহমান, উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত নদীর পানি আটকে দেওয়া হয়েছে। নদীর ওপরে মস্ত এক বাঁধ কিছুকাল আগেই তৈরি করা হচ্ছিল, এখন তাকে কাজে লাগানো হলো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন, নদীর পানি যে মনুষ্যই নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে, সেটা আগেভাগেই দেখতে পেয়েছিলেন। তবে এটা ভাবা নিশ্চয় তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি যে ওপরওয়ালাদের হস্তক্ষেপে তাঁর প্রাণপ্রিয় পদ্মা নদীটি তাঁর দেখা ‘ছোট নদী’টিতে নিয়মিত পরিণত হতে থাকবে। কিন্তু উপায় কি? যেমন চলছে তেমনভাবে তো চলতে পারে না। ওপরের সুবিধাপ্রাপ্তদের সঙ্গে নিচের বঞ্চিতদের অপরিহার্য ও অনিবার্য দ্বন্দ্বের মীমাংসাটা কীভাবে ঘটবে? আপসে? আপসের সম্ভাবনা তো কল্পনা করাও অসম্ভব। হ্যাঁ, মীমাংসা হবে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়েই। ওপরওয়ালারা যদি জিতে যায় অবস্থাটা তাহলে অকল্পনীয় রূপেই ভয়াবহ দাঁড়াবে। হাজার হাজার বছরের সাধনায় মানুষ যে অত্যাশ্চর্য সভ্যতা গড়ে তুলেছে তার বিলুপ্তি তো ঘটবেই, মানুষের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে কি না, সেটাই হয়ে পড়বে প্রাথমিক প্রশ্ন। ভাঙতে হবে তাই ওপর-নিচের ব্যবধান। ওপর শুধু সুখ ভোগ করবে, আর নিচ পোহাবে দুর্ভোগ সেটা চলবে না। ভাঙার এই অত্যাবশ্যকীয় কাজটা ওপরের সুবিধাভোগীরা করবে না, এটা করতে হবে নিচের মানুষদেরকেই। বিরোধটা মোটেই সামান্য নয়; অতিপুরাতন, চলমান ও ক্রমবর্ধমান একটি দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে বঞ্চিত মানুষের জেতার সম্ভাবনা না দেখা দিলে অচিরেই ঘোর অরাজকতা দেখা দেবে। সেটা সামলাবে এমন সাধ্য কারোরই থাকবে না।


লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজবিশ্লেষক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা