অলঙ্করন : প্রবা
দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক
রাজনীতির বাঁক পরিবর্তন
দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আমরা
জানি, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক
ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ
অনুষঙ্গ নির্বাচন। স্বাধীন
বাংলাদেশে তো বটেই, স্বাধীনতাপূর্ব এই ভূখণ্ডে নির্বাচনকেন্দ্রিক
রাজনীতির নানারকম মেরুকরণ-সমীকরণ পরিলক্ষিত
হয়েছে। তবে বিগত
তিন দশকে এ দেশের রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে
বিষয়টি আরও একটু
ভিন্নভাবে দেখা যায়। করে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক
নানারকম মেরুকরণ এবং এই মেরুকরণের
সমীকরণ কখনও কখনও
কিছু নেতিবাচক প্রশ্নও
দাঁড় করিয়েছে। আমরা
দেখেছি, জাতীয় নির্বাচনের
আগে প্রত্যেকবারই রাজনীতিতে
জোট গঠনের প্রক্রিয়াটি
বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তবে এও ঠিক, এমন চিত্র
যে শুধু আমাদের
দেশেই দেখা গেছে
কিংবা দেখা যায় তা নয়। আমাদের
প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ
বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক
রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও এমনটি
পরিলক্ষিত হয়েছে। আমি বিশ্বের বিভিন্ন
দেশেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ
করেছি এবং এ থেকে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়
করেছি, তা যে সব সময় প্রীতিকর মনে হয়েছে,
তাও নয়।
গণতান্ত্রিক
রাজনীতির যেমন কিছু
গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রয়েছে, তেমনি নির্বাচনের
ক্ষেত্রেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের
আমলে রেখেই দায়িত্বপালন
করতে হয়। নির্বাচনী
ব্যবস্থা কিংবা প্রক্রিয়া
যতটা স্বচ্ছ হবেÑ রাজনীতি,
সরকার সব ক্ষেত্রেই
এর ইতিবাচক প্রভাবও
পড়ে থাকে। যদি নির্বাচন প্রক্রিয়ায়
অস্বচ্ছতা থাকে,
তাহলে এর নেতিবাচক
প্রভাবও সমভাবেই পড়ে থাকে। আমাদের
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার
পথ সুগম করতে
সাধারণ মানুষের ভূমিকা
যে কম নয়, তাও অভিজ্ঞতায়
আছে। বর্তমান নির্বাচন
কমিশনের প্রধান নির্বাচন
কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল শপথ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, ‘প্রতিটি নির্বাচনই একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কোনো চ্যালেঞ্জেই ভয় পেলে চলবে না।’ তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার শপথ নেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমেই প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছিলাম, তার নেতৃত্বাধীন কমিশন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় যা কিছু করণীয় তিনি তা করতে সক্ষম হবেন। আমরা জানি, নির্বাচনের গুরুদায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই। সরকার তার সহযোগী শক্তি। কিন্তু তাই বলে সরকারের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের বিষয়টিতে দায়িত্বভার নিয়েই যেভাবে অনুধাবন করেছিলেন, এর জন্য তাকে আমরা সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। ক্রিকেট খেলার মাঠে আমরা দেখি, একজন ব্যাটার ব্যাট চালানোর আগে মাঠের চিত্রটি ভালো করে পরখ করে নেন। নির্বাচন কমিশনের মুখ্য ‘ব্যাটার’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি সেভাবেই বিষয়টি পরখ করেছিলেন এবং বোধ করি তার উপলব্ধির যে প্রকাশটা তখন ঘটেছিল, তাও এরই আলোকে। নিশ্চয় স্বস্তির বিষয়, শুরুতেই তিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করে তাদের চ্যালেঞ্জটা তার চিন্তায় সেভাবেই প্রোথিত করেছিলেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থানীয় সরকার কাঠামোর কয়েকটি স্তরে এবং জাতীয় সংসদের কয়েকটি আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনগুলো নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই রকম কথাই শোনা গেছে। তবে এই কমিশনের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাংবিধানিক
প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের
দায়িত্বশীলদের সংবিধান অনুযায়ী
যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। তারা
যদি ক্ষমতার সদ্ব্যবহার
করে নির্মোহ অবস্থান
নিয়ে দায়িত্ব পালনে
নিষ্ঠ হন,
তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়া
কিংবা ব্যবস্থা নিয়ে
যে নেতিবাচক প্রশ্নগুলো
রয়েছে, এর নিরসন
করা দুরূহ কিছু
নয়। বিশ্বের বিভিন্ন
দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ
করতে গিয়ে দেখেছি, নির্বাচন কমিশনকে
যথাযথভাবে দায়িত্বপালনে কিংবা
চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে কী রকম দৃঢ়তা-স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত
করতে হয়। ইতঃপূর্বে
বহুবার বলেছি,
নির্বাচন কমিশন ঘিরে
যেসব বিতর্ক রয়েছে
এর নিরসনে এবং আস্থা পুষ্ট
করতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ
কাজ করা প্রয়োজন। এ কাজগুলোর প্রথম
ধাপটিই হলো ভোটার
রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি। এই কাজটি কতটা
ঠিক ঠিকমতো হয়েছে
তা খতিয়ে দেখা
জরুরি। সঠিকভাবে ভোটার
রেজিস্ট্রেশন প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের
অন্যতম শর্ত। রাজনৈতিক
দলগুলোর যেমন নানা
ক্ষেত্রে অধিকারের বিষয়টি
যুক্ত, তেমনি ভোটারেরও
কিছু নিশ্চিত অধিকার
রয়েছে। তার মধ্যে
একজন ভোটার নির্বিঘ্নে
কিংবা স্বাধীনভাবে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ
করবেন এটা তার অন্যতম অধিকার। ভোটারের
এই অধিকার ক্ষুণ্ন
হলে রাজনৈতিক দলগুলো
কিংবা নির্বাচনে অংশীজনরা
প্রশ্ন তোলার অধিকার
রাখেন।
আমাদের
দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ার
বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হঠাৎ
করে হয়নি। আমাদের
স্মরণে আছে সেই মাগুরা নির্বাচনের
কথা। তারপর যেমন
অনেক ক্ষয় হয়েছে, তেমনি আবার
অনেক অর্জনও আছে। অংশগ্রহণমূলক
নির্বাচন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক
ব্যবস্থার সৌন্দর্য বাড়ায়। এই কাজটি করার
জন্য নির্বাচন কমিশন
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে
নিবিড়ভাবে পর্যালোচনাক্রমে যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে বিষয়টি
আরও পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া আমাদের
দেশে যে অনুসরণ
করা হয়নি,
তা তো নয়। কিন্তু
দেখা গেছে তাতে
সবার উপস্থিতি সমভাবে
পরিলক্ষিত হয়নি। নির্বাচন
কমিশনের এমন উদ্যোগ
যদি সত্যিকার অর্থেই
আন্তরিক হয়,
তাহলে সবারই সহযোগিতার
হাত বাড়ানো উচিত। প্রযুক্তি
বিকাশের এই যুগে
এখন অনেক কিছুই
ধামাচাপা দিয়ে রাখা
সম্ভব নয়। আবার
এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই
অনেক নেতিবাচক ঘটনাও
ঘটানো সম্ভব। আমরা
দেখেছি, নানা ক্ষেত্রে
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা
ঘটেছে। যেমন ইভিএম
পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে
ইতোমধ্যে ইতিবাচকের চেয়ে
নেতিবাচক কথাই বেশি
হয়েছে। এ ব্যাপারে
আমাদের সার্বিক সক্ষমতার
বিষয়টিও উঠে এসেছে। নির্বাচন
কমিশনের তরফেও সম্প্রতি
এমনই কিছু কথা শোনা গেছে। আমরা
চাই, প্রযুক্তির প্রশ্নমুক্ত
ব্যবহার।
আমরা
জানি, এবারই প্রথম
দেশে আইনি কাঠামোয়
নির্বাচন কমিশন গঠিত
হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া নিয়েও
কোনো কোনো রাজনৈতিক
দল প্রশ্ন তুলেছিল। একটা
কথা মনে রাখা
দরকার, আমরা ইতোমধ্যে
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে
বেশকিছু প্রক্রিয়া পরীক্ষা
করে নিয়েছি। আমাদের
স্মরণে আছে,
বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের
নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র অভিযোগ
উঠেছিল। কোনো নির্বাচনই
শতভাগ প্রশ্নমুক্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। কোনো
না কোনো ক্ষেত্রে
কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়তো
থাকবেই। কিন্তু শতভাগ
ত্রুটি-বিচ্যুতিমুক্ত করার
প্রচেষ্টাটা যদি দায়িত্বশীল
সব পক্ষেরই থাকে, তাহলে ত্রুটি-বিচ্যুতি যতটা
বেশি সম্ভব এড়ানো
কঠিন নয়।
আমাদের
দেশের রাজনীতিতে বর্জনের
দৃষ্টান্তও কম নয়। এই বর্জন দেখা
গেছে নির্বাচনের ক্ষেত্রে
কিংবা কোনো আলোচনার
উদ্যোগের ক্ষেত্রেও। আমার
অভিমত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক
ব্যবস্থায় নির্বাচন বর্জন
মানে নিজেরাই নিজেদের
গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে
বঞ্চিত করা। বিশ্বের
অনেক দেশেই দলীয়
সরকারের অধীনে নির্বাচন
হচ্ছে এবং ওই নির্বাচন নিয়ে
হইচই কিংবা অপ্রীতিকর
কথাবার্তা শোনা যায় না। দলীয়
সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু
নির্বাচন সম্ভব। এর বহু নজির
আমাদের সামনেও রয়েছে। গণতান্ত্রিক
রাজনীতিতে সরকারি দল চালকের ভূমিকায়
থাকলেও বিরোধী দলগুলোর
ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ
নয়। আমরা জানি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে
বিরোধীপক্ষ ছায়া সরকার
হিসেবে বিবেচিত। এমতাবস্থায়
তাদেরও যে দায়িত্ব
কম নয়,
সেটি আমলে রাখা
জরুরি। আত্মসমালোচনা আত্মশুদ্ধির
পথ বাতলে দেয়। একটি
রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করার
জন্য রাজনৈতিক ভূমিকা
গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনীতির
অংশীজন সবারই এক্ষেত্রে
দায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক
রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত
পোষণ কিংবা সমালোচনা
অসিদ্ধ নয়। কিন্তু
নিশ্চয়ই তা হতে হবে গঠনমূলক।
আমাদের
দেশেও ভালো নির্বাচনের
দৃষ্টান্ত অনেক আছে। ওই নির্বাচনগুলোও তো নির্বাচন কমিশনই
করেছে। সংবিধান নির্বাচন
কমিশনকে অনেক ক্ষমতা
দিয়েছে এবং যে কোনো
‘চাপ’ উপেক্ষা করার
মতো শক্তিও সংবিধানই
দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে
সরকারের সদিচ্ছার বিষয়টি
অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে
অংশীজন ও ভোটারদের
নৈতিকতা-সতর্কতার বিষয়গুলোও
সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা
জাতীয় ভোটার দিবস
নামে প্রতিবছর একটি
দিবস পালন করি। প্রত্যেকটি
দিবস পালনেরই সুনির্দিষ্ট
কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে। ভোটার
দিবস পালনের মূল লক্ষ্য ভোটারদের
অধিকার সম্পর্কে সচেতন
করা। একজন ভোটার
যদি তার অধিকারসহ
এ সংক্রান্ত সব বিষয়ে জ্ঞাত
থাকেন, তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ
নির্বাচনের আশঙ্কা কম থাকে। আমি ইতঃপূর্বে বহুবারই
বলেছি, ভোটাধিকারও মানবাধিকার। নির্বাচন
কমিশনের ও সংশ্লিষ্ট
সব পক্ষের মনে রাখা জরুরি, ভোটকেন্দ্রে ভোটারের
হার কমে যাওয়া
ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী
নির্বাচিত হওয়া গণতান্ত্রিক
রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য
শুভবার্তা নয়। এ বিষয়ে নির্বাচন
কমিশনের তো বটেই, সরকারেরও সজাগ
থাকা জরুরি।
আমরা স্বাধীনতার অর্জনের পর ইতোমধ্যে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছি। এই সময়ে আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতি কম হয়নি। আমাদের অর্জনের খতিয়ান যেমন পুষ্ট, তেমনি বিসর্জনের খতিয়ানও কম দীর্ঘ নয়। আমরা চাই, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সব অনুষঙ্গের ঔজ্জ্বল্য একই সঙ্গে সবার অধিকারের সমতল মাঠ। পরমত সহিষ্ণুতার পাশাপাশি গঠনমূলক রাজনীতির পরিবেশ-পরিস্থিতি দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে নিশ্চিত করতেই হবে। আমরা যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ভুলে না যাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সবকিছুই পরিচালিত হওয়া উচিত। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ ওই জনযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি এই বাংলাদেশ।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, ফেমা