অলঙ্করন : প্রবা
আমাদের দেশে সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান শত্রু হচ্ছে দুই সুপরিচিত সখা—পুঁজিতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্র। এরা হাত ধরাধরি করে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছে। বিজ্ঞান ও পুঁজিবাদের মধ্যে অদ্ভুত এক ভালোবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক বিদ্যমান। বিজ্ঞান পুঁজিতন্ত্র বিকাশ ও প্রসারে সহযোগিতা করেছে। পুঁজিতন্ত্র সমাজবিকাশের ধারায় গড়ে ওঠে। তাই একে বিজ্ঞানের তৈরি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে বিজ্ঞানের অসংখ্য আবিষ্কার ও উৎপন্নদ্রব্য পুঁজিতন্ত্র লাভজনক কাজে ব্যবহার করে নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে। অন্যদিকে পুঁজিতন্ত্র যে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে তা বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের অনুকূল। বিজ্ঞান ও পুঁজিতন্ত্র তাই যৌথভাবে মানুষের জন্য এক বিকশিত পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। কারিগর তার ছোট ওয়ার্কশপে কাজ করে এবং বিজ্ঞানী তার ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একে অপরের সহযোগিতায় সম্ভবত তাদের অজান্তেই শিল্পবিপ্লব সম্ভব করে তুলেছে। তবে একই সাথে পুঁজিতন্ত্র বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সুফল মানবজাতির কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেও সচেষ্ট। কেননা পুঁজিতন্ত্র বিজ্ঞানকে তার দাসে পরিণত করতে তৎপর।
পুঁজিতন্ত্র বিজ্ঞানীকে চায় তার কর্মচারী হিসেবে কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশকে সে ভয় করে। কেননা বিজ্ঞান শোষণবিরোধী, কিন্তু পুঁজিতন্ত্র শোষণ ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। এজন্য পুঁজিতন্ত্র শোষণ করার লক্ষ্যে শোষিত মানুষের ভিতর সামন্তবাদী মূল্যবোধকে গড়ে তুলে তা টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করে; এটা একটা প্রদীপ যার তলায় রয়েছে ঘোর অন্ধকার। বিজ্ঞান একটি বৈপ্লবিক শক্তি। একসময় পুঁজিবাদও বৈপ্লবিক ছিল তবে বর্তমানে নয়। আর তাই পুঁজিবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে যাচ্ছে, সৌভ্রাতৃমূলক সম্পর্কের বদলে বিজ্ঞানের সাথে শত্রুতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করছে।
এটা সকলেরই জানা,
সমুদ্র সভ্যতা বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছে, যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে অবদান রেখেছে, চলাচল ও ব্যাপকতার সামর্থ্য বিশেষত ব্যবসা-বাণিজ্যে। সমুদ্রের সাংস্কৃতিক অবদান প্রমাণ করে সাগর আকাশ থেকে অনেক বেশি কার্যকর। আকাশ মূলত ব্যক্তির, সাগর সমষ্টির। বাংলার সমুদ্র রয়েছে কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই সমুদ্র বণিক ও জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই ভূমির দুইপ্রান্ত পাহাড় ও পর্বত দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং অপরপ্রান্ত অনুপ্রবেশকারীর দখলে।
রাষ্ট্র ছিল বাঙালিদের শত্রুপক্ষ। এ রাষ্ট্র বিজ্ঞানচর্চা বিকাশে বাধা হয়েছিল। এজন্য রাষ্ট্র তার প্রজাদের কাছ থেকে আনুগত্য চেয়েছিল। ব্রিটিশ শাসক প্রজাদের আলোকিত করার ভান করত। অবশ্য এটা সত্য যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সত্যিই আলোকিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে প্রতিনিয়ত বাঙালি মানসকে সামন্ত মূল্যবোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। ব্রিটিশরা এদেশে একটি মধ্যশ্রেণি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিল। এজন্য তারা শিক্ষানীতিতে বাঙালিদের ইংরেজি শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা রাখে। এটা অনড় পশ্চাৎপদ প্রাচ্যশিক্ষা থেকে অনেক অগ্রসর ছিল। কিন্তু এটা ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষা। এই শিক্ষানীতি ব্যাপক গণমানুষকে শিক্ষিত করার পরিকল্পনা করেনি। বরং একটি নব্যশ্রেণি সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিল। দ্বিতীয়ত, এই শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দালাল সৃষ্টি করা, যথার্থ শিক্ষিত মানুষের মুক্তি নয়। আর এই দ্বিবিধ উদ্দেশ্যই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আসলে এই বাবুশ্রেণির নাড়ির যোগ ছিল জমির চিরস্থায়ী সামন্ত বন্দোবস্তের সাথে এবং এরা একই সাথে নতুন পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির সাথে সম্পর্ক রেখে নিজেদেরকে ধন্য মনে করত। এটা বলা সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে নতুন মধ্যশ্রেণির সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ফ্যাসিবাদী চরিত্রের, যদিও তখনও ফ্যাসিবাদ মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনযাপনে এরা পিতৃতান্ত্রিকতা সমর্থন করত। দর্শনগত দিকে পুঁজিবাদ অতটা প্রাধান্য পায়নি, যতটা পেয়েছিল সামন্ততন্ত্র।
আসলে মধ্যশ্রেণিটি ছিল পরগাছা,
যারা নাস্তিক্যচেতনা বিকাশে অযোগ্য। একই সাথে এরা আসন্ন গণঅভ্যুত্থানের বিরোধী ছিল যা তৎকালীন সমাজকে ভেঙে ফেলতে পারত এবং নতুন সমাজ অবশেষে মধ্যশ্রেণিরই হতো। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি বাংলায় সমাজবিপ্লবের বিরুদ্ধে খোলাখুলি অবস্থান নেন। তার জাতীয়তাবাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে শত্রু হিসেবে ঠিকই চিনেছিল কিন্তু এভাবে চিহ্নিত করতে ভয় পাচ্ছিল। দেখা গেল এই জাতীয়তাবাদী মধ্যশ্রেণি, যারা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের, তারা ক্ষমতাচ্যুত (অতীত) মুসলিম শাসকদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করল। এই সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্থ বিকাশের পক্ষে ছিল না।
বাংলার মধ্যশ্রেণির দুটি শাখা—হিন্দু এবং মুসলমান উভয়ই ব্রাহ্মণ্যবাদী। ব্রাহ্মণরা আমলাতান্ত্রিক, তারা উৎপাদক নয়, ভোক্তা। সবচেয়ে মারাত্মক কথা—জ্ঞান অর্জন এ শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষকশ্রেণির কৃষির ওপর একটি স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল। কিন্তু তারা বহির্বিশ্বের অগ্রগতির তথ্য জানত না। তাই মধ্যশ্রেণির পক্ষে কৃষির বিকাশের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান অর্জন ও তার প্রয়োগ সম্ভব ছিল। কিন্তু তা তারা করেনি। শাসকদের সহযোগিতা তথা দালালি করে নিজেদের প্রসার ও বিস্তারে ব্যস্ত থাকাই ছিল তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা ছিল একান্তই লোভী এবং সমাজের নিচুস্তরের লোকদের থেকে যা পায় তাই কেড়ে নিতে উদ্যত ছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যশ্রেণির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করে। এর পরিণাম বাংলার বিভাজন।
অসাম্প্রদায়িকতা বিজ্ঞান দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একান্ত দরকার। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সংস্কৃতির ও অসাম্প্রদায়িক হওয়াটা একেবারে গোড়ার ব্যাপার। বাংলার বৃহৎ জনগোষ্ঠী সবসময়ই অসাম্প্রদায়িক। মধ্যশ্রেণি তাদের সাম্প্রদায়িক এবং কোটারি স্বার্থের কারণে তাদেরকে অসাম্প্রদায়িক ও সমষ্টিগত স্বার্থবিরোধী করে তোলে। নির্যাতন ও ভয় দেখানোর পৃথিবীজোড়া মতাদর্শের বিরুদ্ধে অনেক আদর্শ মতাদর্শের উদাহরণ পৃথিবীতে বিরাজমান। যেমন বাংলার বাউলদর্শন। দর্শনগত দিক দিয়ে এরা অজ্ঞেয়বাদী এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবিমুখ। তারা সক্রেটিসের মতো দ্বান্দ্বিক এবং ন্যায়ের পক্ষে যুক্তি-তর্ক করত। কিন্তু এই দুই সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা তাদেরকে স্ব স্ব ধর্মভুক্ত করতে চেয়েছিল। সামন্ততন্ত্র সবসময় তাই চায়। কদিন আগে বর্তমান রাষ্ট্রশক্তি কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার লালন আখড়া ঘেরাও করে পর্যটন স্থাপনা করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করল পুঁজিবাদ কীভাবে মানবিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেয়। সামন্ততন্ত্র যা পারেনি পুঁজিবাদ তা পারল।
উপমহাদেশে প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে চার্বাকরা বস্তুবাদী ছিলেন। কিন্তু তাদের রচনা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উগ্রবাদীদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছে। বাংলায় উপকথা, ধাঁধা, প্রাচীন লোকগান প্রভৃতিতে অসাম্প্রদায়িকতার উপাদান বিদ্যমান। বাংলাভূমি জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানভাবনা তাঁরা তাঁদের সম্প্রদায়ের ভেতর তেমন করে লালন করতে পারেননি। বাংলার ভেষজ ওষুধের ঐতিহ্য ছিল যা টিকতে দেওয়া হয়নি। কৃষক শ্রমিক এবং নারীদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা আছে যার বৈজ্ঞানিক মূল্য রয়েছে, প্রয়োজন এগুলোর পরিচর্যা করা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার মধ্যশ্রেণির জাগরণ পরে রেনেসাঁ হিসেবে বর্ণিত হয়। কিন্তু এটা সঠিক নয়। আসলে একটি পরাধীন দেশে রেনেসাঁ হওয়া সম্ভব নয়। তবে ওই সময়েই অক্ষয় কুমার দত্ত যুক্তি সহকারে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন—প্রার্থনা নয়, শ্রমই শুধু ফসল উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু তিনি প্রধান ধারার লোক ছিলেন না।
প্রশ্ন হলো, এটা ঘটল কেন? আমরা দুই শত্রুকে চিহ্নিত করেছি—সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র। এর সাথে বাংলায় একটি শক্তিশালী ভাববাদী ঐতিহ্য রয়েছে যা বিজ্ঞানভাবনা বিকাশে সহায়ক ছিল না। উর্বর জমি এবং অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতার কারণে এখানে জীবনযাপন ছিল সহজ ও অনাড়ম্বর। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা জীবনযাত্রার মান বাড়ানোতে অনীহা আর একটি কারণ। তাই মানুষের জিজ্ঞাসা কম, সর্বোপরি একটি অদ্ভুত কিন্তু শক্তিশালী ধারণা বিরাজ করছে যে আজ যেমন যাচ্ছে আগামীতেও তেমন যাবে। আসলে এসব লক্ষণ বিশ্বাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে, এর ভেতর সংশয়বাদের উপাদান খুব কম।
রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষায় পরিপূর্ণভাবে সফল নয়। দারিদ্র্য, আশ্রয়হীনতা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর নিত্যসাথী। আশা নেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। এ অবস্থায় এটা বিচিত্র নয় যে মানুষ ধর্মের দিকে ঝুঁকবে, দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে অতিপ্রাকৃত শক্তির নিকট আশ্রয় চাইবে। মৌলবাদের উত্থানও ঘটেছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও আর্থ-সামাজিক হতাশা থেকে। রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। সামন্ততন্ত্রকে দীর্ঘায়িত করে পুঁজিতন্ত্র বাঙালিকে মুক্ত করতে চেয়েছে (মানুষকে মুক্ত করার ইচ্ছা নেই পুঁজিতন্ত্রের, এবং সামন্ততন্ত্র টিকিয়ে রাখে দারিদ্র্য ও দুঃখদুর্দশা)। দারিদ্র্য ও দুঃখদুর্দশার অন্ধকারে বিজ্ঞান দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশলাভ করতে পারে না। বাংলাদেশে আজ সুস্পষ্ট তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে, এর কোনোটিই বিজ্ঞানমুখী নয়। ধনীরা পরিপূর্ণ ভোগবাদী, এখানে বিজ্ঞানের স্থান নেই। মধ্যবিত্তরা অস্থির এবং তাদের বিজ্ঞানচর্চার খুব একটা সময় নেই। দরিদ্ররা তার চতুর্দিকে শুধু অন্ধকারই দেখতে পায়। এ কারণে তারা তো বিজ্ঞানভাবনা চিন্তাই করতে পারে না।
তাই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ নির্ভর করে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার যে অভিগমন তার অগ্রগতির ওপর। কেননা প্রকৃত গণতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত থাকে। থাকে জিজ্ঞাসা করার স্বাধীনতা এবং নিজের মতামত অন্যকে জানানোর পরিবেশ। গণতন্ত্রের মর্ম হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়া। আর অন্য কিছুর আগে বিজ্ঞানের প্রয়োজন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র।
লেখক :
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়